তবে এই পার্ক নগরবাসীর রাগ বা গোসসা কতটা কমাতে পারবে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি নিছক নাগরিকদের আকর্ষণ করার জন্য। এমন পার্ক বিরল নয়। তবে ডিএসসিসি চাইলে তা ব্যতিক্রম করে সাজাতে পারে। বিষয়টি যাতে শুধু প্রচারণার ঝুলিতে আবদ্ধ না থেকে বাস্তবভাবে রূপ নেয় সে দাবি নগরবাসীর।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীতে নিত্য যানজট, ধুলা-বালু, কিছুদিন পরপর সড়ক কাটাকাটি, সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যা লেগেই থাকে। জীবন-জীবিকার তাগিদে এসব সমস্যা এখন অনেকে মেনেও নিয়েছেন। তারপরও তো মাঝেমধ্যে কর্মব্যস্ত জীবনটা বিষিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে- পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটু নির্মল ও নির্জন পরিবেশে সময় কাটানোর। সেজন্যই এমন পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ডিএসসিসির এমন উদ্যোগের ফলে এবার হয়তো মন হালকা করার সুযোগ মিলবে নগরবাসীর। কেননা বিষিয়ে ওঠা মন ভালো করতেই তৈরি হচ্ছে 'গোসসা নিবারণী পার্ক'। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি এই পার্কের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। ঘোষণা অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে পার্কটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সংস্থার প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
সরেজমিনে পার্কে গিয়ে দেখা গেছে, পার্কটি নির্মাণের জন্য পুরো ওসমানী উদ্যানের চারদিকে রঙিন টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ভেতরে চলছে নির্মাণকাজ। পার্কের এক কোণে এই পার্কটি নির্মাণ করা হলেও পুরো পার্ক বন্ধ রাখায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে। তারা বলছেন, এখানে কি এমন পার্ক তৈরি করা হচ্ছে যেখানে গেলেই মানুষের গোসসা চলে যাবে। এমন জাদুর ছোঁয়া সংবলিত পার্ক আমরাও চাই। কিন্তু এজন্য পুরো পার্ক বন্ধ রাখা হয়েছে কেন?
পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নাসির মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন একটা পার্ক বানাচ্ছে যেখানে গেলে মানুষের গোসসা ভেঙে যাবে। রাগ চলে যাবে। তবে হ্যাঁ, মানুষের ভালো লাগতে পারে। এ ধরনের পার্ক নির্মাণের পর কতদিন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়।’
ডিএসসিসি সূত্র জানিয়েছে, নির্মাণ শেষে পুরো পার্কের চারদিক উন্মুক্ত থাকবে। পার্কে জলাধার, মিউজিক সিস্টেম, বসার জন্য আলাদা জোন, শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, পুরোনো দিনের গান শোনার ব্যবস্থা ও বড় স্ক্রিনে টিভি দেখার সুবিধা থাকবে। এ ধরনের পার্ক বাংলাদেশে প্রথম। আন্তর্জাতিক মহলে এরই মধ্যে পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
তবে পার্কটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও খোদ ঢাকাবাসীর মধ্যে নানা সংশয় ও সন্দেহ বিরাজ করছে। কেননা তারা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগগুলোর প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না। সিটি করপোরেশন তাদের যেকোনও প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে নগরবাসীকে যেসব সুফলের কথা বলে তা বাস্তবে মেলে না। নগর পরিকল্পনাবিদদের মাঝেও এই পার্কটির বিষয়ে নানা অভিমত রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক, পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আকর্ষণ করার জন্য অনেক সময় অনেক মজার মজার নাম দেওয়া হয়। ওসমানী উদ্যানের এই পার্কটি বিরল তা বলা যাবে না। অনেক সময় এটা হাসি-তামাশার বিষয় হতে পারে। এখানে শুধুমাত্র গোসসা নাম দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হয়েছে। এমন নাম দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট না করাই ভালো। এই পার্কে যেসব সুবিধার কথা বলা হয়েছে তা সবসময় সকল নাগরিকদের জন্য করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওসমানী উদ্যানের মতো একটি উদ্যোন বন্ধ করে দিয়ে এভাবে পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক না। এটা একদমই অন্যায়।’
জানতে চাইলে স্থপতি মোবাশ্বর হোসেন বলেন, ‘আমি এই পার্কটিসহ দক্ষিণ সিটির ৩১টি খেলার মাঠ ও পার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। আরও ২০০ জন আর্কিটেক্ট কাজ করছেন এ প্রকল্পে। আমার মনে হয়েছে, এই পার্কটিতে যেসব সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাতে অনেক সমৃদ্ধ একটি পার্ক হবে। পার্কগুলো এলাকার লোকদের মতামতের ভিত্তিতে গঠন করা হয়েছে। তবে এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রক্ষণাবেক্ষণ।’
স্থপতি রফিক আজম বলেন, ‘এটাকে এমনভাবে চিন্তা করে তৈরি করা হয়েছে যেখানে মানুষজন গেলে মেডিটেশন করতে পারবে, চা খেতে পারবে, আড্ডা দিকে পারবে। পুরো পার্কে কোনও দেয়াল থাকবে না। যখন-তখন পার্কে প্রবেশ করা যাবে। পার্কে নগর মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি থাকবে। খেলা বা মিউজিকও দেখা যাবে। পানি প্রকৃতি আর আধুনিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। আমরা একে এমনভাবে করতে চাই যাতে সেখানে গেলে যেকোনও রাগ নিবারণ হয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, পার্কের ভেতর একটি লেক তৈরি করা হবে, যেখানে সারা বছর পানি থাকবে। আশপাশের এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা এমনভাবে করা হবে যাতে বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি এই লেকে চলে আসতে পারে। গোসসা নিবারণ পার্ক সবার জন্য সার্বক্ষণিক উন্মুক্ত থাকবে।’
এ বিষয়ে ডিএসসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মো. বিলাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এমন একটি চিন্তা থেকে বিশেষজ্ঞ দলের সমন্বয়ে এই পার্কটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি যাতে নগরবাসী এখানে এসে রিলাক্স নিতে পারেন। পার্কটির সঙ্গে প্রকৃতি ও জলরাশির এমনভাবে মিলন ঘটানো হবে যাতে মানুষ রাগ বা গোসসা সবই ভুলে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারে।