বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতিবছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। এ কারণে প্রতিবছর মারা যায় চার লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এছাড়া, ৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়, মধ্যে প্রতিবছর প্রাণ হারায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।
জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই স্যালমোনেলা জীবাণু বহনকারী আইসক্রিম খাওয়ার ফলে দুই লাখ ২৪ হাজার মানুষ রোগে আক্রান্ত হয়। ১৯৮৮ সালে দূষিত শামুক ও গলদা চিংড়ি খেয়ে চীনে প্রায় ৩ লাখ মানুষ রোগাক্রান্ত হয়। ২০০৮ সালে চীনে তৈরি কয়েকটি কোম্পানির গুঁড়ো দুধ পান করে বহু শিশু রোগাক্রান্ত হয়। ওই দুধে মেলামাইনের মাত্রা বেশি ছিল।
বাংলাদেশও এ দুধ আমদানির মাধ্যমে আসে। সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে সরকার ওই দুধসহ উন্নত দেশের কয়েকটি ব্র্যান্ডের দুধ আমদানি নিষিদ্ধ করে। পরে আমদানিকারকরা এ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা করলে আদালতের নির্দেশে সবগুলো ব্র্যান্ডের দুধ বিদেশে আর্ন্তজাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর আমদানির জন্য কয়েকটি ব্র্যান্ডকে ছাড়পত্র প্রদান করে।
ইলিশের পাশাপাশি শিশুদের জন্য আমদানি করা গুঁড়ো দুধেও ভয়াবহ মাত্রার ক্ষতিকর সীসা পাওয়া গেছে। ফলে গুঁড়ো দুধ আমদানির ক্ষেত্রেও পরীক্ষা ছাড়া বন্দর থেকে খালাস না করার আদেশ দেওয়া হয়।
গত ২৫ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিএসটিআই মহাপরিচালক ও দেশের সব কাস্টমস কমিশনার ছাড়াও বিভিন্ন দফতরে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে বলা হয়, আমদানি করা কিছু ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধে ক্ষতিকর সীসা পাওয়া গেছে। খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমদানি পর্যায়েই তা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আমদানি করা গুঁড়ো দুধের প্রতিটি চালান বন্দর থেকে খালাস করে ল্যাব টেস্টে সীসা পরীক্ষার ফল না পাওয়া পর্যন্ত গুদামজাত করে আমদানিকারকদের নিজ জিম্মায় রাখতে হবে। কোনও অবস্থাতেই পরীক্ষার ফল না পাওয়া পর্যন্ত তা বাজারজাত করা যাবে না মর্মে অঙ্গীকারনামা দিয়ে চালান খালাস করতে হবে।
এর বাইরেও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভয়াবহ দিক হলো খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরের ১৫টি বাজার থেকে সংগৃহীত মুরগির নমুনা পরীক্ষায় অ্যান্টিবায়োটিক রেসিডিউ পাওয়া গেছে। এছাড়া, খাদ্যে ফরমালিন, ভেজাল, রঙ মিশ্রণ তো আছেই। আরও আছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার উৎপাদনের প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে এসব বিষয় কিছুটা কমিয়ে আনা গেলেও তা একেবারে বন্ধ করা যায়নি।
দেলওয়ার জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরাসরি উৎপাদন করা কাঁচা সবজি বা মাছ কোথায় উৎপাদিত হচ্ছে, সেটা পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। উৎপাদনের ক্ষেত্রে সেচের পানি কিংবা চাষের জমির মাটিটা নিরাপদ কিনা— এসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।’ প্রাকৃতিক কৃষিজাত পণ্যের সঙ্গে বাজারের পণ্যের তুলনা করে তিনি বলেন, ‘‘বাজারের পণ্য উৎপাদনের সময় হরমোনসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দেওয়ায় বিভিন্ন ধরনের দূষণ হয়। আমরা যে খাদ্য উৎপাদন করি, তাতে রাসায়নিক বা হরমোনের নামে, ‘বিষ’ দেওয়া হয় না।’’
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন তৈরি করে সরকার। ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর এই আইনের আওতায় ২ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
সংস্থাটির সদস্য ও যুগ্ম সচিব মাহবুব কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খাদ্যকে নিরাপদ করার জন্য কারও সঙ্গে কোনও ধরনের আপোস করার সুযোগ নেই। এই লক্ষ্যে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান থেকে শুরু করে চিঠি দিয়ে সতর্ক করাসহ কিছুই বাদ রাখিনি। এর পাশাপাশি আমরা ৬৪ জেলায় প্রচার অভিযানে নামছি খুব শিগগিরই। শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) নিরাপদ খাদ্য দিবসে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হচ্ছে অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের সব কর্মকর্তাদের ব্রিফ করবো। একটু সময় দিতে হবে। তাহলে নিরাপদ খাদ্যের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা অবশ্যই সম্ভব।’