পণ্যে জিআই সনদ পাওয়ার সুবিধা কী?

ইলিশ ও জামদানিমসলিনের পর বাংলাদেশের জামদানি ইতোমধ্যে বৈশ্বিক ক্রেতাদের নজর কেড়েছে। দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে জামদানি। এরপর বাংলাদেশের ইলিশ মাছও জিআই সনদ পেয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘ভৌগোলিক নির্দেশক’ (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) জিআই পণ্য হিসেবে অনেক আগেই স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশের জামদানি। সম্প্রতি বাংলাদেশের ইলিশ মাছ জিআই সনদের স্বীকৃতি পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার ২৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এ সনদ হাতে পেয়েছে মৎস্য অধিদফতর। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আরিফ আজাদের হাতে জিআই সনদ তুলে দেন। এই সনদ বাংলাদেশের জন্য খুবই গর্বের বলে মনে করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু।
জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে জামদানি ও ইলিশ সারা বিশ্বেও স্বীকৃতি পেয়েছে। পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ইলিশ ও জামদানির নাম নিবন্ধনসহ এর সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সনদ তুলে দেওয়ার কাজ শেষ করেছে অধিদফতর।
পণ্যের জিআই সনদ পাওয়ায় সুবিধা কি? এ প্রসঙ্গে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরের রেজিস্ট্রার সানোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ উৎপাদকদের পণ্যের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেয়। এতে অন্য দেশের সমজাতীয় পণ্য থেকে তাদের পণ্য আলাদাভাবে চেনা যায়। এর ফলে তাদের এই পণ্যের আলাদা রেপুটেশন তৈরি হয়। বিশ্ববাজারে উৎপদনকারীরা পণ্যের জন্য ভালো দাম পান। ট্রেডমার্কের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো—ট্রেডমার্ক কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিতে পারেন কিন্তু ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ একটি দেশ প্যাটেন্ট করতে পারে। যা সেই দেশের পণ্য হিসেবে বিশ্ববাজারে পরিচিতি পাবে। এতে স্থানীয় উৎপাদকরা ভালো দাম পাবেন। মোট কথা জিআই পণ্য কোনও দেশ আমদানি করতে চাইলে তাহলে উৎপাদনকারী দেশকে একটি নির্ধারিত হারে রয়েলটি পরিশোধ করতে হবে। যা জিআই সনদ না পাওয়া পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না।’
জিআই পণ্য প্রক্রিয়ায় একটি দেশ তার দেশের নির্দিষ্ট কিছু পণ্যকে নিবন্ধন করে। এর ফলে ওই পণ্যটি যেমন ব্র্যান্ডিং পায়, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে সেই পণ্যের মূল্যও বাড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বাংলাদেশ জামদানি ও ইলিশের জিআই সনদ পাওয়ার পর এখন নকশিকাঁথা, ফজলি আমসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পণ্যকে জিআই পণ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। বাংলাদেশের বিশেষায়িত পণ্য জিআইয়ের নিবন্ধন পেলে দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেমন বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং পাবে, তেমনি দেশীয় পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যও বাড়বে।
পটুয়াখালীর আড়তে ইলিশকিভাবে ইলিশ জিআই পণ্য হিসেবে সনদ পেলো, এর প্রক্রিয়া কী, জানতে চাইলে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরের রেজিস্ট্রার সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘মৎস্য অধিফতর আমাদের কাছে রুপালি ইলিশের জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করে। ওই আবেদনের পর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার করে এ বছরের ১ জুন গেজেট প্রকাশ করা হয়। আইন অনুযায়ী গেজেট প্রকাশিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে দেশে বা বিদেশ থেকে এ বিষয়ে আপত্তি জানাতে হয়। কিন্তু কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কোনও আপত্তি জানায়নি। এর অর্থ হচ্ছে— কেউ আর এ পণ্যেও স্বত্ব দাবি করছে না। সে অনুসারে এ পণ্য এখন বাংলাদেশের স্বত্ব।
ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশ জন্মে বাংলাদেশে। ভারতে ১৫ শতাংশ, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশ এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোয় বাকি ১০ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে।
জিআই পণ্য সংরক্ষণে বাংলাদেশকে জিআই নিবন্ধনে আরও ভালো করতে হলে এ ক্ষেত্রে গবেষণা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক বেলায়েত হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন পণ্যের ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। পণ্যের জিআই নিবন্ধনের জন্য যথাযথভাবে তথ্য-উপাত্তসহ তাদেরই ডিপিডিটিতে আবেদন করতে হয়।’
জানা গেছে, ভৌগলিক নির্দেশক আইনের মাধ্যমে ভারত ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানিকে অন্ধ্র প্রদেশ এর উপ্পাদা জামদানি হিসেবে, বাংলাদেশের নকশী কাঁথাকে পশ্চিম বাংলার পণ্য হিসেবে, বাংলাদেশের চিরচেনা ফজলি আমকে পশ্চিম বাংলার মালদা জেলার অধীনে প্যাটেন্ট করিয়েছে।
ভারত নজর দিয়েছিলো বাংলাদেশের ইলিশের উপরও। বাদ যায়নি বাংলাদেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের স্বত্ব নিতে চেষ্টা করছে ভারত। ভারত দাবি করছে— এটির অরিজিন ভারতে, সেভাবেই আন্তর্জাতিক প্যাটেন্ট করিয়েছে ভারত। সেইসঙ্গে নিজেদের প্রাণি হিসেবে সংরক্ষণের নামে ‘আন্তর্জাতিক প্রাণি সংরক্ষণ সংস্থা’ থেকে মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট নিয়েছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তত্ত্বাবধান ও উদারীকরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ২৩টি চুক্তির একটি হচ্ছে— ‘বাণিজ্য-সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি বা ট্রিপস (ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস)। এই চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারায় পৃথিবীর সব প্রাণ-প্রকৃতি-প্রক্রিয়ার ওপর পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে। এই চুক্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি এবং কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘকাল ধরে উৎপাদিত হয়ে আসছে, তার ওপর সংশ্লিষ্ট দেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক আইন করে নিবন্ধন করে রাখার বিধান রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইলিশ ও জামদানি রফতানিতে বাংলাদেশ লাভবান হবে। বাংলাদেশের রফতানি আয়ও বাড়বে। কারণ, জিআই সনদ পাওয়া এসব পণ্য আমদানি করতে চাইলে আমদানি কারককে রয়েলটি দিতে হবে।’