সমকালীন ফিলিস্তিনি গল্প

নুরা আল-আশির ‘ভাই হারানোর বেদনা’

নুরা আল-আশির জন্ম সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল আজমান শহরে। তার পরিবার মূলত গাজা থেকে এসেছে। ২০১৫ সালে গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংরেজি এবং আরবি উভয় ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন। 'উই আর নট নাম্বারস' ম্যাগাজিনের তিনি একজন সৃজনশীল লেখক এবং ‘ফিলিস্তিনি ফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর সাবেক অনুবাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি গাজার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ান।

একদিন দখলদার ইসরাইলি সৈন্যবাহিনী গাজার উপর অবৈধভাবে বিমান হামলা চালায়। অনেকগুলো সামরিক বিমান আকাশের একদিক থেকে অন্যদিকে উড়ে যায়। আকাশ ছিল ধূসর, যদিও তখন ভোর। গাজা যেন আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উঠে গেছে। মনে হচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে বোমাবর্ষণ চলছে; কিছুক্ষণ মাটি কাঁপা বন্ধ থেকে পুনরায় কেঁপে উঠে। তখন ছিল শীতকাল। প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছিল। চারপাশের ভবনগুলো ধসে পড়ার ভয়ে বাসিন্দারা কেউ বাইরে যেতে ইচ্ছুক ছিল না।

আমার ভাই অসুস্থ ছিলেন। প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ সত্ত্বেও দৃঢ়ভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তার যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি ছিল। সারাদিন অপেক্ষা করেও তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সুযোগ পাইনি। আমি কাঁদছিলাম এবং খুব একা বোধ হচ্ছিল। আমার ভেতরে প্রচণ্ড ভয় কাজ করছিল। আশেপাশের সবাই প্রিয়জনের দুশ্চিন্তায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কেউই আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি, কেননা তারা নিজেরাই ছিল খুব ব্যস্ত। আর আমি স্বাভাবিকভাবে ইতোমধ্যে যা জেনেছি, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা এড়িয়ে যাই। আমি অবাক হয়েছি। আমার চিন্তাভাবনাগুলো আশা এবং ভয়ের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতায় মেতে ছিল।

আমি আমার ভাইয়ের কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ অগণিত মানুষের ভিড়ে তাকে দেখতে পেলাম। কিন্তু তিনি বেদনার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চলে যান।

আমি স্বপ্নের ভেতর ভাবতে থাকি, তাকে আবার দেখেছি। কিন্তু তার কাছে পৌঁছুতে পারিনি; শুধু আমার হৃদয়ে তার স্নেহ-ভালোবাসার স্মৃতি চিরকাল লালন করতে পারি। আমার ভাই ছিলেন সেই মহৎ ব্যক্তি, যিনি আমাকে সুখী করেছিলেন এবং জীবনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। আমি তাকে এমনভাবে ভালোবাসতাম, যেন তিনি এখনো জীবিত এবং আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের অংশ হয়ে আছেন। যদিও আমি জানতাম আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে যাওয়ার চেয়ে আমার সহ্য করার ক্ষমতা ছিল ঢের বেশি। তিনি সেই রক্ত, যা আমার শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে এবং আমাকে জীবন দিয়েছে। আমি আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে বিশ্বাস করতাম, আমরা সবসময় দুটি দেহে এক আত্মা হয়ে থাকব। যদিও আমাদের মধ্যে এখন সীমাহীন দূরত্ব—এমনকি একবার দেখা, কোনো কথা বলা কিংবা ক্ষণিকের জন্যও হাসাহাসির সুযোগ নেই।

আমি আমার ভাইকে স্বপ্নে দেখেছি। দিনের উজ্জ্বল আলোতেও তার মুখ কল্পনা করেছি। অবশেষে বুঝতে পেরেছি, আমাদের আত্মার মধ্যকার দূরত্ব ক্রমশ শীতল শূন্যতায় পরিণত হচ্ছে। প্রচণ্ড দুঃখ নিয়ে ভাবতে থাকি—তাকে ছাড়া আমার জীবন ভীষণ অন্ধকারে ঢেকে যাবে। আমি অনুভব করছি—আশা-আকাঙ্ক্ষার অর্থ এবং এমনকি আশা-আকাঙ্ক্ষায় বিশ্বাস রাখার ক্ষমতাও আমি হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাকে প্রমাণ করতে হবে—ভাইয়ের স্মৃতি লালন করে আমি এগিয়ে যেতে পারি; আমার ভাই হয়ে ওঠেন আমার দিন এবং রাত। ভাই আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন, তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন, দেখতে এসেছিলেন, কিন্তু আমার জীবনে প্রবেশ করতে পারেননি।

তারপর একদিন আমার ভাই উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে অনেক বছর ধরে দুঃখ দিয়েছি। অনুগ্রহ করে আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ভুলে যাও। অবশ্যই আমাকে তোমার বিশ্বাস করতে হবে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার কারণে আমি চাই, তুমি নিজের মতো তোমার জীবন যাপন কর।’

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিলাম, ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে আরও কষ্ট হচ্ছিল। আমি যেকোনোভাবে তার কণ্ঠস্বর শুনতে চেয়েছি এবং চিরকাল তা ধরে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু আমি সত্যটা অনুভব করতে পারছি, যা শুনতে পাচ্ছিলাম।

তারপর শুনতে পেলাম আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠেছি। তখন চিৎকারের তীক্ষ্ণ আওয়াজ অশুভ উদ্দেশ্যে উপরের দিকে চলে যায়। এমনকি যখন আমি বুঝতে পারলাম, আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে তখন আমার অন্তর-আত্মা তাকে ডাকছিল। আমি চোখ খুলে তাকে জান্নাতে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার বোন, মেয়ে এবং মা। এখন আমরা আরেকবার একত্রিত হয়েছি।’

‘ভাই হারানোর বেদনা’ (দ্য অ্যাগনি অব লস) গল্পটি ‘উই আর নট নাম্বার্স’ অনলাইন ম্যাগাজিনে ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় (পুনঃপ্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২২)।