একটা মফস্বল শহর। যেখানে শিল্পকলার মেয়েশিশুদের কোনোভাবেই হাতে-পায়ের তাল এক হয় না, তারা যে যার মতো নৃত্যে পারদর্শিতা দেখায় আর নৃত্যের শিক্ষিকা প্রায় একই সহজ নাচের মুদ্রা প্রতিদিন শিখিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রংচটা পুরাতন চকচকে চটি পড়ে বাইরে মাধবীলতার ঝোপের পাশে অপেক্ষমাণ প্রেমিকের সাথে দেখা করে বাড়ি ফেরে। যেখানে একটা কাক বৈদ্যুতিক তারে বসে দ্বিধায় থাকে, সে পূর্বদিকে প্রেমিকা লাঈলী চাচীর বাড়ির দিকে যাবে নাকি পশ্চিমে যাবে, যেখানে মোজাম্মেলের গোলগাল মেয়েটা চিৎকার দিয়ে পড়তে থাকে— “স্বরে অ, স্বরে আ, হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ঈ”...যেখানে কোনো এক ভোরে সুফিয়া বেগম ছেলেকে ডাকতে গিয়ে বলেন একা একাই— “বাবু, ও বাবু ঘুম দিয়া উঠলি না? কী বললি? গা ম্যাজম্যাজ করে? থাক তাইলে আইজ আর ইস্কুলে যাইয়্যা কাজ নাই। তত্তোরি ওঠ, গরম ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর আলু ভাজা খাবি...ওঠ ওঠ। লেখাপড়া শিইখ্যা কে কবে জজ-ব্যারিস্টার হইছে আর কয়টা টাকাই বা ইনকাম করছে। তারচেয়ে আমার পোলা বাইচ্যা থাক।” যে মফস্বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আনজুমকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় একটা কলম সহকারে, সবাইকে সে ছলেবলে কৌশলে কথার ফাঁকে বুঝিয়ে দেয় সে লেখালেখি করে, সে আর সব অতি সাধারণ মফস্বলের মানুষদের মতো না। একটু পরেই ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে পত্রিকা বের করতে দেখা যায়, যেখানে অতি সম্প্রতি তার চার লাইনের একমাত্র কবিতা ছাপা হয়েছে জাতীয় পত্রিকার সাহিত্যপাতায়, একেবারে নিচে এক কোণে।
এমনি মফস্বলের এক গলিতে সবুজ রঙের একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় প্রায়ই। কিছুক্ষণ পর দু-কামরার বাসা থেকে জর্দা দেয়া পান মুখে ভরে মিল্লাতকে বের হতে দেখা যায়। সে সিএনজিতে উঠেই এক টানে বের হয়ে যায়। একটু দূরে গিয়েই একজন যাত্রীকে তুলে নেয় সে। সেসময় মাইকে নিখোঁজ সংবাদ শোনা যায়। কে একজন বলে— “ভাইসব, ভাইসব গতকাল সন্ধ্যায় এলাকার পানির ট্যাংকির মোড় থেকে নয়ন শেখ, পিতাঃ আজগর শেখ নামক একটি নয় বছরের ছেলে হারিয়ে গেছে। সে সময় তার পরনে ছিল লাল শার্ট, হলুদ প্যান্ট। ছেলেটির গায়ের রঙ শ্যামলা, স্বাস্থ্য ভালো, ছেলেটির কপালের ডানপাশে একটি কাটা দাগ আছে। কেউ যদি তার সন্ধান পান তাহলে যোগাযোগের জন্য অনুরোধ করা গেল। যোগাযোগের ঠিকানাঃ নয়ন বস্ত্রালয়, পানির ট্যাংকির মোড়।” মিল্লাত গাড়িতে বসে থাকা যাত্রীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে ওঠে— “এখন দেখবেন খেইল। দুইদিন পরপর নিখোঁজ হইব। সেতু তৈয়ার হইতেসে, অনেক মাথা লাগব। ছেলেধরা নামছে।” এরপর বসিরের ছেলে একদিন নিখোঁজ হয়ে যায়। তার দু-দিন পর ফয়জুল চাচার ছেলে...এরপর মরিয়মের মেয়ে। এ সময় একদল মানুষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে, সেতু তৈরিতে না, এদের সৌদি আরব সহ বিভিন্ন দেশে পাচার করে দেয়া হচ্ছে উটের জকি হিসেবে আর কিশোরী মেয়েদের সৌদির বাড়িগুলোতে গৃহপরিচারিকা হিসেবে—সেই সাথে বাড়ির মালিকদের যৌনচাহিদা পূরণের জন্য। আরো শোনা যায় তাদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হচ্ছে নিয়ে গিয়ে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও পাচার হচ্ছে।
সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম জোরদার করা হল। কারণ হিসেবে জানা যায়, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনায় সারাদেশের সতেরো জেলায় নয়জন নিহত হয়েছে। এদের কেউই ছেলেধরা ছিল না। কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রোশের জের ধরে ছেলেধরা পরিচয় দিয়ে এ কাজ করা হয়েছে।
নেত্রকোণায় সজীব নামক একজনকে হত্যা হয় ছেলেধরা হিসেবে। পরে লাশ ময়নাতদন্তে উঠে আসে হত্যার আগে তাকে বলাৎকার করে ঘাতক রবিন।
গ্রাম থেকে শহর, সেতুর আশেপাশের এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু চক্র জনগণের অবচেতন মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। এ সময় বিরোধীদলগুলোও সরকারের বিরুদ্ধে একটা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। তারা এই সেতু গুজবে আরো উসকানি দেয়। এ সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী টিভিতে এসে বক্তব্য প্রদান করেন— “দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে। আমাদের এই মেগাপ্রকল্প দেশ তথা বহিঃবিশ্বের কাছে একটা রোলমডেল হিসেবে দাঁড় হবে কিন্তু একদল কুচক্রীমহল একে বাধা দিতে চাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের একটাই কথা, আপনারা থেমে যান। আপনাদের উদ্দেশ্য কখনোই সফল হবে না। সবকিছুতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। দেশ এগিয়ে যাবে, বিশ্ব-দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।” টিভিতে প্রচারিত এ সংবাদ সিএনজি চালক মিল্লাত তখন তার দু-কামরার বাসায় বসে মুড়িমাখা খেতে খেতে শোনে আর হাসে। তার সবকিছু ভুয়া মনে হয়, সেতুর বিষয়ই আসল।
এরপর পত্রিকায় খবর ছাপা হল, চারজেলা থেকে চারজনকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আটক করেছে। লাকসাম উপজেলার আশাবী গ্রাম থেকে হায়াতুন্নবী, চট্টগ্রামের আনোয়ারার বিপ থেকে আরমান, রাজবাড়ীর পাংশা থানার পাঠদা থেকে পার্থ, নড়াইল থেকে ইউসুফ। এদের সবাই গোপনে গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছিল কাটা মাথা, ছেলে ধরা বিষয়ে ভুয়া নাম ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এ ব্যাপারে সেতু প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান— “হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রম, অনেক প্রকৌশলীদের দক্ষতায় গড়ে উঠছে এসব সেতু। এখানে মানুষের মাথা কাজে লাগানোর বিষয়টা একেবারেই অবাস্তব।” মিল্লাত সেটা শুনে শুধু হেসে বলে— “শালা!”
ঘটনা গড়াতে থাকে। জামালপুরে শ্বশুর হোসেন আলীকে হত্যার পর মাথা ও দেহ আলাদা করে ফেলে মেয়ের জামাই খোরশেদ আলী। গুজব রটানো হয়, মাথা ব্রিজের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ির পাশে নতুন সেতু তৈরিতে। ঘটনার দু-দিন পরে জামালপুরের মেরাম থানা পুলিশ তার দেহ উদ্ধার করে আর ইসলামপুর থানা পুলিশ করে মাথা উদ্ধার। ঘটনার আগের দিন হোসেন আলীর মেয়ে সাবিনা তার স্বামীকে ফোন দিয়ে বলে তার ছেলে অসুস্থ। সেই মুহূর্তে আরো জানে যে খোরশেদ আলী “চাক্কু” ধার দিচ্ছে। পরবর্তীতে বিলাপ করতে করতে তাকে বলতে শোনা যায়—“আল্লাহগো আমি তো বুঝি নাই এই চাক্কু ধার কীসের জইন্য দেয়, আমার বাপেরে মারনের লাইগ্যা।” পুলিশের কাছে সে জবানবন্দিতে স্বীকার করে শ্বশুরকে সেই চাক্কু দিয়ে মাথা আর দেহ আলাদা করে গুজব রটিয়ে দেবার। কারণ হিসেবে জানা যায় হোসেন আলী খোরশেদ আলীকে মামলা দেয় তার মেয়েকে শারীরিকভাবে জখম এবং যৌতুকের টাকা আদায়ের জন্য যা ইতঃপূর্বে সাবিনার বিয়ের সময়ই নগদ পঞ্চাশ হাজার দেয়া হয়েছিল। প্রতিশোধ হিসেবে খোরশেদ এই কাজ করে। মিল্লাত তখন চায়ের দোকানের টিভিতে এই খবর শুনতে পায়, তার মনে হয় সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এই নাটক সাজানো হয়েছে। সে তার সিএনজির যাত্রীদের সাথে সেতুর জন্য সবজায়গা থেকে প্রাপ্ত নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যার হিসেব দেয়।
এক সকালে সাংবাদিকদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফোকলোর বিশেষজ্ঞ শিহাব শাহরিয়ার জানান— “কুসংস্কারের কারণে নানা ধরনের নানামাত্রিক আচরণ ঘটে। সেরকম একটা আচরণের বহিঃপ্রকাশ এই মাথার খুলি। যারা অপসংস্কৃতি, ধর্মান্ধ তারাই এ ধরনের অপপ্রচার ছড়িয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে।”
এরপর সাংবাদিকরা ছুটে যায় আইন মন্ত্রীর কাছে। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেন— “এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তৎপর রয়েছে। সেই সাথে গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান।” মিল্লাত সব দেখতে থাকে, শুনতে থাকে আর বলতে থাকে— “এগ্লা সব মিছা কথা।”
এলাকার গাউসুলের মা, যে কিনা এক লাউয়ের কোনোকিছুই ফেলতে রাজি না। লাউ দিয়ে ডাল বা বড় মাছের মাথার ঝোল, লাউয়ের খোসার ভাজি, লাউয়ের বিচির ভর্তা, লাউ শাকের চচ্চড়ি বা পাতুরি। যে বাসার ফিলিপস বাতিটা লাগানো, ফ্যানের সুইচ ঠিক করা সহ টুকটাক ইলেকট্রিশিয়ানের কাজটা নিজেই সেরে ফেলে। নিজের ব্লাউজ, পেটিকোট বানানো সহ বিভিন্ন কাপড়ের ফুল তোলা, সেলাই করা ওয়ালম্যাট বানিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয় আর এলাকাবাসীর প্রশংসা কুড়োয়। যে এলাকায় ইতোমধ্যে জনপ্রিয় তার নানা বিষয় পারদর্শিতা—জ্ঞান নিয়ে, তাকে পর্যন্ত বলতে শোনা যায় ব্রিজের কাজে ছেলেধরা, কাটা মাথা সম্পর্কে— “মা বলছিল, প্রত্যেক কাজের একটা ধক থাকে। এইরকম ব্রিজ বানানোর সময় পানির নিচে যে দ্যাও আছে, তারে খুশি করা লাগে। নাহয় সে ব্রিজ বা কোনোকিছু বানাইলে টিকতে দেয় না। যারা বানায় তাগো মাইরা ফেলে, বংশ নির্বংশ কইরা দ্যায়। এই দ্যাওরে খুশী করার জইন্য আগেই কিছু কাটা মাথা উপহার দিতে হয়। হে রক্ত চায়, নরমুণ্ড বলি চায়। হে একটা হিন্দু।”
পাড়ার তারকাখচিত ছোট মসজিদের হুজুর, যিনি প্রায়ই একজনের বাণী আরেকজনের বলে চালিয়ে দেন জোড়াতালি দিয়ে খুতবাসহ সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের দিন, দু-একদিন নিজের মনের কথাই বাণী হিসেবে চালিয়ে দেন। একদিন সকালে তাকেও চিন্তিত থাকতে দেখা যায়। কারণ গত রাতে দেখা স্বপ্ন। তার আশেপাশে বসে থাকা কয়েকজন এলাকার লোকজনের সাথে সে বলেই ফেলে— “স্বপ্নে দেখলাম, এবার আর রক্ষা নাই। কাটা মাথা দেওয়াই লাগবে বুঝলা। স্বপ্নে দেখলাম চারপাশে শুধু রক্তের সাগর আর আমি তার ভিতর নৌকা বাইতাসি। কাটা মাথাগুলান আমারে অভিশাপ দিতেসে। বলতেসে, কী দরকার আছিলো আপনেগো এই ব্রিজ করার? হুজুর আপনে তো একটু পারতেন আমাগো বাঁচাইতে, আমরা আপনের উপর ভরসা করছিলাম” স্বপ্নের বয়ান শেষ করতেই তার চোখে পানি চলে আসে। আশেপাশের সবাই তার অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে হা হুতাশ করতে থাকে। সেই পানি শুকিয়ে যাওয়ার আগেই হুজুর পরবর্তী জুম্মাবারে তৌহিদ মুন্সীর বিরিয়ানি দিয়ে মিলাদ দেওয়ার বিষয়টা নিয়ে আরো একবার নিশ্চিত হয়।
এতো জল্পনা-কল্পনার ভিতর দিয়ে সারাদেশে সেতু তৈরির মেগাপ্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলে। কাটা মাথার সাথে এবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে বড় সেতুতে টোল দেওয়া, এর সৌন্দর্য, কত দ্রুত পৌঁছানো যায়, দেশের আর্থিক সহ সামগ্রিক উন্নয়ন, বিদেশি সাহায্য তথা বিনিয়োগ এসব নিয়ে। এর ঠিক কদিন পর আনুমানিক দিনক্ষণ বলা যাবে না, মিল্লাতের আর খোঁজ পাওয়া যায় না। তার সিএনজিটা পড়ে থাকে ব্রিজের নির্মাণাধীন কাজের কাছাকাছি। যে সন্ধ্যায় মিল্লাত নিখোঁজ হয়, সেই রাতেই প্রথম গাঁজাখোরদের চোখে পড়ে ব্যাপারটা। তারা সম্ভাব্য যা যা খুলে নেয়া যায়, সব খুলে নিয়ে যায়। পরদিন সেতু এলাকার আশেপাশের কিছু শিশুদের সেখানে চড়ে পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে দুলে খেলতে দেখা যায় এবং মুখ, ঠোঁট ফুলিয়ে ইঞ্জিন চালু করার একটা শব্দ শোনা যায় মিথ্যা ভান করে— ভোও ও ও ও...ভুম ভুম পুলিশ পৌঁছাতে পৌঁছতে সেখানে আর মিল্লাতের সিএনজির সেরকম কিছুই অবশিষ্ট থাকে না পরিত্যক্ত কঙ্কালের মতো। শেষে পুলিশের কনস্টেবল দুজন বিরক্তি নিয়ে এই জিনিস কী করা যায় সেটা নিয়ে ভাবে। তারা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। পরদিন আবার আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তার পরের দিন...তার পরের দিন... একসময় আসা বন্ধ হয়। কদিনের ভিতর সেটা শিশুদের খেলনায় পরিণত হয়। দূর থেকে সবাই শুনতে পায়— ভোও ও ও...ভুম ভুম।