ধারাবাহিক উপন্যাস

লাবণ্য দাশের চিঠি ।। পর্ব—১২

আমার বদনামের পাশাপাশি একটা কথা তুমি ঠিকই বলেছ যে, তোমার মিলুদা বিয়ে করতে চায়নি এবং বিয়ে করা তার একেবারেই ঠিক হয়নি। তোমার কি মনে হয় বিয়েটা কেন করেছে? বিয়ে-সংসার-সন্তান দরকারি মনে করত বলে? আমার তো মনে হয় তোমাকে আঘাত দেবে বলে অথবা তোমাকে পাবার আশা আর ছিল না বলে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার মন থেকে সে সরে গিয়েছিল তা সত্যি, একইসাথে এও সত্যি যে সে নিজেও কখনোই মনে স্থান দেয়নি আমায়। ইচ্ছাও ছিল না। তবে তার গল্পে যেমন লিখেছে, তেমনি করে একটা ভদ্রতা বজায় রেখেছে। বিয়ের পর যত আঘাতই আমি পাই না কেন, সেসব সামলে নিয়ে বরিশালের সেই গ্রামে তার সাথেই তো জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছি। সত্যিকারভাবে ভালোবাসলে সে পারত আমাকে জয় করতে, সে তা করেনি। সে কেবল আমাকে এড়িয়ে গেছে।

বিয়ের পর থেকেই আমাদের পার্থক্যগুলি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল দ্রুতলয়ে। ফলে সম্পর্কটা আর দানা বাঁধল না। এর পরপরই আবার সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মরতে মরতে বেঁচে শরীর ভাঙল—অসুস্থ সন্তান অসুস্থ স্ত্রী সাথে আমার রাগারাগি, কান্নাকাটি। আগেই বলেছি আমার প্রবল রাগ ছিল খামখেয়ালি করে আমার জীবন নষ্ট করার জন্য। পদে পদে সে কথা জানান দিতাম। তোমার দাদা একেবারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল। অবশ্য আমার প্রতি অনাগ্রহ, অবহেলা, তাচ্ছিল্য স্পষ্ট করার মতো অভদ্র তোমার দাদা নয় কিন্তু পাশাপাশি বসবাস করলে পশুও মালিকের মন বুঝতে পারে আর আমি তো রীতিমতো বুদ্ধিমতী। আমরা পারস্পরিক অপছন্দে দুই মেরুতে অবস্থান করতাম। শুধু সাংসারিক যৌথতা ছিল। বরিশালের একান্নবর্তী পরিবারে তেমন ধরা পড়ত না সেসব আর তোমার দাদা কখনো চাকরি কখনো কলকাতা মিলিয়ে বাড়িতে কম থাকত, আমিও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই মুখোমুখি কমই হতে পারতাম।

বিয়ের পর থেকেই অনেকসময় অদ্ভুত লাগত ভেবে যে, মানুষটা চায় কী! কী তার পছন্দ! বাইরে যাবার সময় ফরসা ধুতি পাঞ্জাবি চাই, সাজানো গোছানো ঘরদোর চাই, পরিপাটি করে খেতেও ভালোবাসে তা এগুলো করবে কে? সংসারে কোনো কাজের লোক তো নেই। আমাকেই সব করতে হয়। তো সেটা আবার তার পছন্দ হয় না। আমি সারাক্ষণ ঘরকন্না নিয়েই আছি, আমার ছোট চিন্তা আমি অতি তুচ্ছ মানুষ এই ভাবটা সবসময়েই দেখাতো। একটা উপেক্ষা, বিরক্তি ফুটে উঠত চোখে-মুখে। একদিনের কথা বলি, অনেকগুলো কাপড় ধুয়ে উঠোনে শুকোতে দিয়েছি। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম তাই দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙতে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। ছুটে বের হলাম কাপড় তুলতে দেখি কাপড়গুলো ততক্ষণে ভিজে হদ্দ, কিছু নিচেও পড়ে গেছে অথচ তোমার দাদা আর মঞ্জু বারান্দায় বসে কবিতার আলাপ করছে। আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। দুজনকেই ধাতানি দিলাম তো তোমার দাদা বলে কিনা— ‘তুমি কি একদিনের জন্যেও সংসারের একটু ওপরে উঠতে পারবে না? কোনোদিন এক মুহূর্তের জন্যেও কবিতা নিয়ে একটু কথা বলবে না?’ আমিও রেগে বলেছিলাম ওসব কবিতার আমি ধার ধারি না। যদিও কথাটা সত্য নয়। কবিতা আমি পড়তাম তবে কবিতাতেই মগ্ন হয়ে থাকতাম না। সংসারের হিসেব-নিকেশও আমাকে রাখতে হত। ওই যে ভেজা কাপড়গুলো তো আবার আমাকেই কাচতে হয়েছিল, অভাবের সংসারে আরও কতগুলো সাবান খরচ হলো বলে আফসোসও এসেছিল মনে।

হ্যাঁ, একথা আমি কায়মনোবাক্যে স্বীকার করি যে, তোমার দাদা কখনোই আমার স্বাধীনতায়, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছায় সামান্যতম বাধা দেয়নি বা অনাগ্রহ দেখায়নি বরং যতটা পেরেছে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করেছে। চাকরি পেতেও তোমার দাদা যথেষ্টই সহযোগিতা করেছে। এমনকি অভিনয় করতেও। সেই সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের বউ ঝি কমার্শিয়াল অভিনয় করবে, এটা মানা অনেক পুরুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল না কিন্তু তোমার দাদা বাধা তো দূর উলটো সহযোগিতা করেছে। তৎকালীন মানুষদের থেকে অনেকখানি এগিয়ে থাকার প্রমাণ এটা, যদিও আমি এর ভুল ব্যাখ্যাই করেছি সবসময়। আমার মনে হয়েছে, তার চাকরি পাবার যোগ্যতা নেই বলেই আমাকে চাকরি করার বা অভিনয় করার উৎসাহ জোগাচ্ছে। তখন তো সমাজকাঠামোতে পুরুষ বলতেই দাপুটে পুরুষের একটা অবয়ব প্রচলিত ছিল। সংসারের প্রবল প্রতাপ স্বামীদের কাজই ছিল নারীকে নানাভাবে দমিয়ে রাখা, এতে তার নিন্দা হত না। এমনকি আমার ঋষিতুল্য শ্বশুর সরাসরি দাপট না দেখালেও পরোক্ষ একটা দাপট তার ছিল। আমি দেখেছি পরিবারের প্রধান তিনিই, আমার শিক্ষিত ও প্রতিভাময়ী কবি শাশুড়ি নন। কিন্তু আমাদের সংসারে তোমার দাদা সব বিষয়েই আমার মত জিজ্ঞেস করত বা আমাকেই দায়িত্ব দিত। বলা যায় সংসারের কর্তৃত্ব ছিল আমার হাতে, আমার ওপর সব দায়দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে সে লেখায় বসে থাকত। তোমার দাদার এই নরম স্বভাবকে আমি তার দুর্বলতা হিসেবে নিয়েছিলাম। আমার অল্পবয়স আর জ্ঞানের অপরিপক্বতার কারণে এ যে সৃজনশীলতার কোমলতা তা বুঝতে পারিনি। ওর মতো মানুষকেই নিশ্চয় অর্ধনারীশ্বর বলা হয় আমি তখন তা বুঝিনি। আমার বরং এমন একটা বোধ ছিল যে ওর সামর্থ্য নেই তাই সাহস নেই ইত্যাদি।

আমার বিপ্লবী স্বভাব এরকম প্রশ্রয়ে খানিকটা স্বেচ্ছাচারীও হয়ে উঠেছিল বলা যায়। মন যা চায় কিছু না ভেবে তাই করে ফেলতাম বা বলে ফেলতাম। অনেক সময় রাগ বা বিরক্তির মুখে সমীহ থাকত না। একদিন তোমার দাদা বলেছিল মানুষের জীবনের চেয়ে পাখির জীবন অনেক ভালো, যদি পাখি হতে পারতাম। আমি জীবনবাদী মানুষ আমার কাছে মানবজন্ম হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। বললাম কীভাবে? সে বলল কী সুন্দর এক দেশ থেকে আরেক দেশে উড়ে বেড়ানো যায়, পাখি হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতাম। আমি বললাম, যখন শিকারির গুলি লাগে আর নিচে নামলে যে বেড়ালে শেয়ালে খায়? অবশ্য কাক হলে ঠিক আছে, এসবের কিছুই হবে না। কাকও তো পাখি তুমি কাকের বেশি হতেও পারবে না। বলেছিলাম তাকে আঘাত করতে সে কিন্তু হেসে ফেলল!

আরেকটা ঘটনা বলি, তাদের ব্রাহ্ম পরিবার। যদিও তোমার দাদা অবিশ্বাসী ছিলেন। তো আমি আমার ঘরে দেবী কালির একটা ছবি রেখেছিলাম। আমার শাশুড়ি সেটা দেখে একটু থমকে ছিলেন, কিন্তু কিছু বলেননি হয়ত ছেলের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। তোমার দাদা কিন্তু একটি কথাও বলেনি। তার কাছে ধর্ম ছিল ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার বিষয়। কোন ধর্মের পক্ষেই উগ্রতা বলা ভালো কোনো বিষয়েই উগ্রতা তার পছন্দ ছিল না। তাই যখন সাহিত্যে প্রগতিশীল আন্দোলনের ঢল বয়ে গেল সে সরে রইল। কমিউনিজমের ধ্বজাধারী কবিতাও সে লেখেনি। এসব নিয়ে অনেক নিন্দা, কটুকাটব্য তাকে সইতে হয়েছে কিন্তু নিজের বিশ্বাস থেকে সরেনি সে। ব্রাহ্মধর্মের নৈতিকতার বাড়াবাড়িও তার খুবই অপছন্দ ছিল কিন্তু নীরবে। আমার শ্বশুর যা বলতেন চুপচাপ শুনত, ধর্মসভায় যোগ দিত না। ধর্ম সম্পর্কে তার পড়াশোনা ছিল বিস্তৃত। দেশি-বিদেশি অসংখ্য সাহিত্যের বই যেমন পড়েছে তেমনি ইতিহাসের, দর্শনের, বিজ্ঞানের আর তেমনি ধর্মগ্রন্থও পড়েছে। পৃথিবীর কোনো ধর্মেরই লিখিত ধর্মগ্রন্থ বোধহয় বাদ দেয়নি।