ধারাবাহিক উপন্যাস

লাবণ্য দাশের চিঠি ।। পর্ব—তিন

আমিতো শৈশবেই পোড় খাওয়া মেয়ে। আমাদের বিশাল বাড়ির হাসি-আনন্দে ভরা সংসার একেবারে ভেঙে পড়েছিল আমার ছোটবেলায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে গভীর আঘাত আর অনিশ্চয়তায় পুরোপুরি মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। পরে আমাদের কাকাদের চেষ্টায় আর ভালোবাসায় সেই দুঃখ আমরা সম্পূর্ণ কাটাতে না পারলেও জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তি সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম বলে জ্যাঠামশাই আমাকে গিড়িডিতে উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করলেন। ছোট থেকেই বোর্ডিংয়ে থাকায় আমি আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর আর খুবই স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছিলাম। এগুলো যদিও গুণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা, আমার বেলায় তা হয়ে গেল দোষ। আমি প্রতিবাদ করি, আমার সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে জানাই ও তাতে অটল থাকি প্রয়োজনে তর্ক করি। সংসারের শান্তি শান্তি পরিবেশ তাতে বিঘ্ন হয়। অনেক স্বপ্ন লালন করছিলাম ইডেনের হোস্টেলে। চারদিকে বিপ্লবী বাতাস, আমিও নিজেকে সেভাবেই তৈরি করছিলাম। অথচ হুট করে এক বিয়ের পর জীবন হয়ে গেল লন্ডভন্ড!  

বিয়ের পর বরিশাল যখন গেলাম বাড়িঘর দেখে আমি সত্যিকারের হতভম্ব হয়েছিলাম। বড় বড় কয়েকটা মাটির ঘর! আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এরকম বাড়ি আমার শ্বশুরবাড়ি হতে পারে! আমার পা আমার অজান্তেই থেমে গিয়েছিল। আমি ইতস্তত করছি দেখে তুমিই না আমাকে ‘এসো ভাই’ বলে হাত ধরে নিয়ে এলে ঘরে? তোমাকে কত আপন মনে হলো তখন! সত্যি কথা বলতে কী তোমার স্মার্টনেস সেই ভূতুড়ে পরিবেশে আমাকে খানিকটা ভরসা দিয়েছিল। মনে হয়েছিল তোমার মতো একটা মেয়ে যখন এ বাড়িতে থাকছে তাহলে ব্যাপারটা তেমন খারাপ নয় নিশ্চয়ই। হয়ত আমি এরকম দেখিনি বলেই ভয় পাচ্ছি। 

কিন্তু পরে দেখলাম তা ঠিক না। তুমি তো চলে গেলে। আমার জন্য খুব কঠিনই হলো সব কিছু মানিয়ে নেয়া। ভাষা থেকে শুরু করে খাবারের অভ্যাস, চালচলন সবই আমাকে নতুন করে শিখতে হয়েছে এবং তা সম্পূর্ণভাবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে, রুচির বিরুদ্ধে। তোমাদের বাড়ি গ্রামের মধ্যে খুবই সম্মানিত ছিল; একেবারে আলাদা মহৎ এক বাড়ি। শ্বশুর মশাই সারাক্ষণই পড়েন বা ব্রাহ্মমন্দিরের কাজে ব্যস্ত থাকেন। শাশুড়ি মা বিখ্যাত কবি হলেও তাকে সারাক্ষণই দেখেছি রান্নাঘরের ঝুলকালিতে পিষ্ট হতে। সবার কাছে তা স্বাভাবিক দৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, আমারও তেমনিভাবে মিশে যাওয়াকেই হয়ত স্বাভাবিক দেখাতো কিন্তু আমি তা করলাম না, উলটো কবে কলেজে ভর্তি হব এই প্রশ্ন করতে লাগলাম অনবরত। গ্রামের বিভিন্ন বয়সের নারীরা আসা-যাওয়া করত তাদের সাথেও আমার বিস্তর ব্যবধান রচিত হলো আমার কারণেই। তাদের কূটনামি, একসাথে খোলা জায়গায় খোলামেলা স্নান, অরুচিকর ঠাট্টা, গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়া, জড়িয়ে ধরা, উঁকুন বাছাবাছির  এরকম অনেক অভ্যাস আমার একেবারে অসহ্য লাগত। গ্রামবাংলার অন্যান্য সাধারণ মেয়েদের জন্য সেটা হয়ত তেমন সমস্যার বিষয় না কিন্তু আমি তো স্বপ্ন দেখা বিপ্লবী মেয়ে, আমি আবার রুচিতে শহুরে এলিট, আমার জন্য সবকিছু বড় নির্মম হয়ে দেখা দিল। 

অবশ্য এর মাঝেও সুন্দর কিছু স্মৃতি আজও উদ্বেল করে। তোমাদের বাড়ির ঘাস লতাপাতায় জড়ানো সবুজ আঙিনা কী চমৎকারই ছিল! আরও ছিল কৃষ্ণচূড়া, মাধবীলতা, গন্ধরাজ এমনি অনেক ফুলগাছ। জানালা দিয়ে ফুলের গন্ধ এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে ঘর থেকে বের হয়ে দেখতাম সবুজ আঙিনায় একটি চেয়ারে বসে তোমার দাদা পড়ছে বা লিখছে। যেদিন মন ভালো থাকত এগিয়ে যেতাম তারপর দুজনে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতাম খানিকটা। একবার শরতের এক সকালে হাঁটছি, দেখলাম কিছুটা দূরে একটি শিউলি গাছের নিচে অজস্র শিউলি ঝরে পড়েছে। আমি ছুটে গিয়ে কয়েকটি কুড়িয়েই তোমার দাদাকে বললাম, ‘গাছটা ঝাঁকাওতো, গাছে আরও ফুল আছে।’ সে ঝাঁকালো না হেসে বলল, ‘অনেক তো আছে, ওগুলোই নাও না, এত দিয়ে কী হবে।’ আমি তো সবসময়ের জেদি। এ কথায় বেশ রাগ হলো। ঝট করে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘বেশ আমিই ঝাঁকাচ্ছি, দুর্বল ভাব না কি আমাকে?’ তোমার দাদা আমার হাত ধরে ফেললো। একটু জোর দিয়েই বলল, ‘না ঝাঁকিও না।’ অপমানে আমার চোখে জল এল। সাধারণ ভাবনা থেকেই আমার মনে হলো সে গ্রাম্যপুরুষগুলোর মতো বলপ্রয়োগ করছে। কিন্তু তোমার দাদা পরক্ষণেই আমাকে গাছের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ওদিকে দেখো।’ দেখলাম। ঘন পাতার ভেতর একটি পাখির বাসা। তার ভেতর থেকে কচি দুটি ঠোঁটসহ মুখের একাংশ বেরিয়ে আছে। বলল, ‘ওদের মা গেছে খাবার আনতে, ওরা অপেক্ষা করছে। ঝাঁকালে ভয় পাবে না?’ সে হাসল আমিও হাসলাম। এক মুহূর্তে মনের সব কালিমা মুছে গিয়ে শরতের আকাশের মতোই ঝকঝকে হয়ে উঠলো। কিন্তু সবদিন এমন হওয়া তো সম্ভব ছিল না। প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা, সাপ-কীট-কেন্নো এসবও তো ছিল। বলা ভালো এসবই বেশি ছিল।

তোমার দাদার গ্রামের বাড়ির পরিবার একটি অতি মাত্রার মিতব্যয়ী পরিবার, যার প্রধান আমার শ্বশুর। যাকে আমার বরও কি না কৃপণ বলে। আসলে কার্পণ্য নয়, তারা অনেক কিছুরই প্রয়োজন বোধ করতেন না। আমার শাশুড়ি অত্যন্ত মলিন, এমন কী ছেঁড়া-ফাটা শাড়ি দিনের পর দিন হাসিমুখেই পরতেন। যতদিন তা পরা অসম্ভব না হচ্ছে নতুন শাড়ি আসত না। আমার শ্বশুরও সস্তা মোটা ধুতি পরতেন কিন্তু প্রচুর বই কিনতেন। বেশ বড়সড় একটি লাইব্রেরি তিনি গড়ে তুলেছিলেন তুমি তা জানো। তোমার দাদার বই পড়ার অভ্যাস সেই লাইব্রেরি থেকেই। ব্রাহ্ম সমাজের অনেকেই সেখানে বই পড়ত। অনেক বই পড়তে আমার শ্বশুরমশাই তাদেরকে সাহায্য করতেন। কৃপণ মানুষ কি তা পারে? কৃপণতা নয়, ভোগটাকেই তারা বিলাস মনে করতেন। তাদের সকলেরই জ্ঞানপিপাসু স্বভাব। ওই বাড়িতে মহত্ত্বের একটা প্রতিযোগিতা চলত যেন। কে কত বেশি মহৎ হতে পারে। সেই বাড়িতে ষোলোটি বছর, সেই শ্বশুরের গলগ্রহ হয়ে থাকা কী যে অসম্মান, কী সেই মানবেতর জীবন, তুমি সারাজীবনের ধনীর মেয়ে কী করে বুঝবে। 

আমিও গরিব ঘরের মেয়েতো ছিলাম না । বাবা-মা বেঁচে থাকতে বেশ জৌলুস ছিল সংসারে, বেশ সচ্ছলভাবেই বড় হয়েছি। স্বভাবেও খানিকটা শৌখিন। ভালো খেয়েপরে, সেজেগুজে, সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে ভালোবাসি। এতো কৃচ্ছতা আমার কাছে দগ্ধে দগ্ধে মরারই শামিল ছিল। তুমিতো ওই বাড়িতে তেমন একটা থাকনি তাই বুঝতে পারবে না এতসব মহৎ মানুষের ভেতর আমার কেমন দমবদ্ধ লাগত। এই ধাক্কা সামলাতে যখন হিমশিম খাচ্ছি একইসময়ে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ, সন্তান পালনে আর্থিক অসচ্ছলতা, বেকার এবং উদাসীন স্বামী যে কি না আবার সামান্যতম ছায়া দেয় না বরং পালিয়ে বেড়ায়, তখনের অবস্থা তুমি কি ভাবতেও পারো? চেষ্টা করো শোভনা, তোমারই সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারার কথা। আমার শাশুড়ি পারবেন না, আমার জা নিনিও (নলিনী) পারবে না বুঝতে, কারণ তাদের পরিস্থিতি আলাদা। তারা ভালোবেসে সব জেনেশুনে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের স্বামী। আমার ছিল সম্পূর্ণ একার লড়াই। 

এই ম্যাড়ম্যাড়ে গ্রাম্য জীবন আমার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠল। তার ওপর লেখাপড়ায় বাধা এল। শুরু করলাম জেদাজেদি, তাতে শেষপর্যন্ত বলা হলো পরীক্ষা দিতে হবে, তাতে পাশ করলে তবে পড়ার অনুমতি মিলবে। খুব রাগ হয়েছিল। ইচ্ছে করেছিল বলি, ‘এখন কেন পরীক্ষার কথা উঠছে? বিয়ের আগেইতো কথা দেয়া হয়েছে যে পড়তে দেয়া হবে।’ কিন্তু বলিনি। বুঝেছিলাম এটাই শেষ সুযোগ। ততদিনে এত বদনাম কুড়িয়ে ফেলেছি যে ভয় হয়েছিল এ কথা বললে লেখাপড়া করার শেষ সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই পরীক্ষাই দিয়েছিলাম দাঁতে দাঁত চেপে আর পাশ করে পড়া শুরু করেছিলাম। আমার এই সব টানাপোড়েনের দিনগুলো তুমি দেখনি ঠাকুরঝি। দেখলে কি কিছুটা বুঝতে আমার যন্ত্রণা? হয়ত বুঝতে, হয়ত বুঝতে না, তবে প্রতিক্রিয়া একই হতো তা এখন আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। তোমার দাদার মৃত্যুর পর আমাকে পদে পদে অপমানিত হতে হবে এটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বুঝে গেছি বেশ। চলবে