ইভান বুনিনের উপন্যাস

মিতিয়ার ভালোবাসা ।। অধ্যায়ー১৩

দিন যায়, কিন্তু চিঠি আর আসে না। কিন্তু তার মন বলছিল, চিঠি আসবে, চিঠি আসবেই। মিতিয়া নিজেকে বলছিল চিঠি আসবেই, কিন্তু চিঠি আসে না। ধীরে ধীরে তাকে একটা অস্বস্তিতে পেয়ে বসল, আর এই অস্বস্তি তার অন্তর্গত সুখানুভূতিকে খোঁচাতে থাকল। শুধু দিনের বেলাতেই নয়, অস্বস্তি তাকে রাতের ঘুমের ভিতরেও তাড়া করতে লাগল।
বাগানটি নানা রঙে আরও সুন্দর হয়ে উঠছিল, ফুলগুলি ফুটছিল। বাগানের দক্ষিণদিকটায় বিস্তৃত দৈত্যাকৃতির ম্যাপল গাছটি, যাকে সব দিক থেকেই দেখা যায়, মনে হচ্ছিল যেন আরও বড় হয়ে জাঁকিয়ে বসেছে। একেবারে উপরের দিকে যে শাখাগুলি রয়েছে, তার পাতাগুলি ছিল আশ্চর্য‌্যজনকভাবে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। মিতিয়ার জানালা দিয়ে যে মূল রাস্তাটা দেখ‌া যায় তা যেন আরও প্রশস্ত ও স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছিল। পুরানো লেবু গাছগুলির মগডাল পর্যন্ত পাতায় ছেয়ে ছিল, যদিও এখন পর্যন্ত উঁচু অংশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু বসন্ত আসার পরই ডালপালাগুলি পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে নতুন পাতারা মিলেমিশে একটা সবুজের আড়াল তৈরি করছিল। ম‌্যাপল গাছের নিচে, গাছপালাগুলির নিচ দিয়ে যেখানে চলার পথটি রয়েছে, সেখানে যেন ছড়িয়ে থাকা ফুলগুলি তৈরি করেছে মাখনের সমুদ্র, যেখানে রৌদ্রকরোজ্জ্বল বাতাসে চমৎকার গন্ধও ছড়াচ্ছে।

আকাশি নীল আকাশের নিচে, বিশাল ঘন ম‌্যাপল গাছের উঁচুতে, লেবু গাছের হালকা সবুজ কুয়াশা আর বিয়ের সাদা সাজে সজ্জিত আপেল, নাশপাতি আর বুনো চেরীফলগুলো। বাগানের যে অংশটি পাহাড়ের ঢালুতে গিয়ে পড়েছে সেখানের প্রতিটি গাছে ফুল ফুটেছে। মূল রাস্তায় ও ছোট ছোট পথগুলিতে, বাড়ির দেয়ালের পাশে ফুটেছে লাইলাক গাছ, আকাশিয়া, বাবলা, বৈচি ফুল, ভাটুই গাছ, বিছুটি, কৃমিকাঠ—এই সবকিছুরই প্রাচুর্য, সজীবতা ও নতুনত্ব তাকে বিস্মিত ও আনন্দিত করে তুলছিল।
চারদিকের এত বেশি গাছপালা দ্বারা পরিবৃত হওয়ার কারণে উঠোনটাকে মনে হচ্ছিল ছোট, আর বাড়িটাকেও ছোট মনে হচ্ছিল। তবে বাড়িটাকে সুন্দর লাগছিল, মনে হচ্ছিল গাছপালাগুলো বাড়িটাকে সাজিয়ে রেখেছে। যেন বাড়িটা কারো অপেক্ষায় সেজেগুজে রয়েছে। দিনের পর দিন দরজা-জানালাগুলি খোলা ছিল প্রতিটি রুমের। সাদা বসার ঘর থেকে শুরু করে, নীল রঙের পুরানো বসার ঘরটি যদিও নীল তবু ছোট ছোট আসবাবে পরিপূর্ণ, সূর্যালোকিত লাইব্রেরি ঘরটি, সবচেয়ে বড় খালি কক্ষটি যার এক কোণে শ্রদ্ধা জানাবার জন‌্য রয়েছে প্রাচীন মূর্তি, এবং দেয়ালে রয়েছে বইয়ের তাক। গাছের ডালপালাগুলি যেন আনন্দে আর স্ফূর্তিতে নেচে উঠছিল আর বাড়ির চারপাশে এমনভাবে নেমে আসছিল যেন তারা রুমের ভিতরে উঁকি দিচ্ছিল। পাতাগুলি কখনও রঙিন, কখনও গাঢ় সবুজ, কখনও হালকা সবুজ, কখনও শাখা প্রশাখার মাঝে আকাশের নীল রঙের মতো উদ্ভাসিত।
কিন্তু এতসব সুন্দরের মাঝেও চিঠি আসেনি। মিতিয়া অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। সে জানত যে কাতিয়া চিঠি লিখতে পছন্দ করে না, তার জন‌্য কাগজ-কলম ও খাম নিয়ে টেবিলে বসা খুব কঠিন। তার চেয়েও কঠিন স্ট্যাম্প কেনা ও চিঠির বাক্সে সেটিকে পোস্ট করতে যাওয়া। মিতিয়া নিজেকে আশ্বস্ত করেছিল, এটা ভেবে যে, চিঠি ছাড়াও সে গত পনেরো দিন চিঠি আসার আগের সময়টাতে ভালোই ছিল। কিন্তু চিঠির জন‌্য এই অস্বস্তি তাকে মস্কোর খারাপ দিনগুলিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয় চিঠিটির প্রত‌্যাশার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সে যে-রকম সুখী ও গর্বিত নিশ্চিত বোধ করেছিল তা চলে যাচ্ছিল। তার মন চঞ্চল হয়ে উঠছিল, মাত্রাতিরিক্ত উৎকণ্ঠায়। পরের চিঠিটি হওয়া উচিত আরও বড়, আরও সুন্দর। কিন্তু কাতিয়ার কোনো সাড়া নেই।

এখন সে ক্ষেতে-খামারে বা গ্রামে একেবারেই যায় না। কিছুদিন ধরে সে লাইব্রেরিতে সময় কাটাচ্ছিল, বইয়ের তাক থেকে কিছু বই খুঁজছিল, কিছু বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখছিল যেগুলি শুকনো হয়ে হলুদ হয়ে যাচ্ছিল অনেকদিন ধরে পরে থেকে। পড়াশুনা সে পছন্দ করত না। তার বন্ধু প্রোটাসভ তাকে সবসময়ই “একটা অশিক্ষিত” বলতে। কিন্তু এই যে বইগুলি সে লাইব্রেরিতে বসে দেখছিল সেখানে পুরানো দিনের কবিদের লেখা কিছু চমৎকার কবিতা ছিল। চমৎকার সব কবিতা— যদিও তারা একই কথা বলছিল, পৃথিবীর শুরু থেকে সেই একই কথা, সেই একই গান, যা তার হৃদয়কে তৃপ্তি দিচ্ছিল। সে আবিষ্কার করল এই কবিতাগুলো অবশ্যম্ভাবীভাবে তার নিজের জন‌্য ও কাতিয়ার প্রতি তার ভালোবাসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ‌্য।

অলৌকিক বসন্তের দিনে
তারা বসেছিল নদীর ধারে
মেয়েটি, ছিল সদ‌্য প্রস্ফুটিত তারুণ্যে
ছেলেটি,যুবক হওয়ার দিকে—

প্রায়ই সে বসে থাকতে পুরো সময় ধরে সূর্যালোকিত শান্ত লাইব্রেরিতে, বইয়ের তাকের পাশে হাতলওয়ালা চেয়ারে শান্ত সমাহিত ভাবে। আর মধুর অত্যাচারে আনন্দিত হতে থাকত বইগুলি বার বার পড়ে।

সবাই ঘুমিয়ে; বন্ধু, চল ছায়াবৃত বাগানে
সবাই ঘুমিয়ে আর শুধু তারাটি আমাদের দিকে তাকিয়ে
তারা আমাদের দেখতে পাবে, কিন্তু শাখা-প্রশাখার ভিতর দিয়ে অস্পষ্টভাবে
তারা আমাদের কথা শুনতে পাবে না, বুলবুল পাখির জন‌্য
সে শেষপর্যন্ত পারবেনা, সে গায় খুব উঁচু স্বরে
শুধুমাত্র আমাদের হৃদয় আমাদের কথা শুনছে
তারা জানে কত আনন্দ
কত সুখ আছে ,আমাদের কাছে।

এতসব প্রেমের কবিতাগুলো, এত সব আবেদন সবই যেন সে নিজেই লিখেছে, এবং এই কবিতাগুলোর মধ্যে দিয়ে মিতিয়া যেন সর্বত্র ও সবখানে তাকে ও তার প্রেমকে দেখতে পাচ্ছিল এবং মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছিল সে কিছু সতর্কবার্তাও যেন পাচ্ছিল কিছু কিছু কবিতার ভিতর দিয়ে।

হাঁসেরা ডানা ঝাপটাচ্ছে
শান্ত জলে, তাদের পাখার ঝাপট
নদীর জলে ঢেউ।
আসো, তারারা জ্বলছে
পাতারা মৃদুভাবে দুলছে
আর মেঘগুলো হচ্ছে একত্রিত।

চোখ বন্ধ করে সে কাঁপছিল, পুনরাবৃত্তি করছিল, বারবার যেন সে কবিতা পাঠ করছিল না, যেন প্রার্থনা করছিল। প্রণয়াবেগে ভরপুর তার কান্না যেন তার হৃদয়কে দলিত-মথিত করছিল। বিজয়ের জন‌্য সে ছিল তৃষ্ণার্ত এবং চাইছিল এক সুখী সমাপ্তি। তারপর সে অনেকক্ষণ ধরে জানালার নিচে যে বাগান আছে তার দিকে তাকিয়ে থাকল, সবুজ ঝোপের দিকে, পুরো বাগানের রাজা মেপল গাছটির দিকে, যা তার দাদুর লাগানো। তার বাড়ির চারপাশে ঘিরে থাকা গভীর নৈঃশব্দ‌্যকে সে শুনছিল, এবং বারবার মাথা ঝাঁকাচ্ছিল তিক্তভাবে। না, কাতিয়ার কোনো জবাব নেই, সে অন‌্য কোথাও উজ্জ্বল হয়ে আছে, মস্কোর অপরিচিত ও দূরবর্তী সেই জগতে, তার আবেদনের প্রতি সাড়া না দিয়ে। এটা কি তার জায়গা ছিল! সে কি তাকে এই কথা বলেনি;

তোমার কি মনে পড়ে মেরী
সেই পুরানো বাড়ির কথা
সেই শতবর্ষী পুরানো লেবু গাছটির কথা
দাঁড়িয়ে থেকেছিল, তন্দ্রাচ্ছন্ন
পুক‌ুরের পাড়ের কথা
নীরব গলিপথের কথা
পরিত্যক্ত পুরানো বাগানের কথা
আর উচ্চতর চিত্রশালা
যেখানে আছে প্রাচীন প্রতিকৃতি?

তার চোখে এক ব‌্যাখ‌্যাতীত কান্না ছিল, যখন সে কবিতাগুলো পড়ছিল। এগুলি ছুঁয়ে যাচ্ছিল তার প্রেমকে, মিলে যাচ্ছিল তার প্রেমের সঙ্গে। সে জানেনা কেন এগুলি তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল।

প্রিয় ওক গাছের সারি, আমি তোমাদের
কিন্তু আমি তো একাকী আসিনা
তোমার ছায়াতলে ছায়া পাব বলে
বরং উল্টোভাবে
তোমার পবিত্র ছায়ায়
নিয়ে আসি আমার প্রার্থনার সাথীকে
আমার তরুণী স্ত্রীকে
যার কোলে একটি শিশু রয়েছে।

কিন্তু এই কবিতা পড়তে পড়তেই যেন অন‌্য একটি কবিতা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

গরমের দুপুরটা বিশ্রামের জন‌্য ডেকে যায় আমাকে
প্রতিটি শব্দ, এমনকি পত্রপল্লবের শব্দরাও থেমে গেছে
প্রতিটি সুগন্ধময় ও আশ্চর্য সুন্দর গোলাপে
গুবরে পোকারা ঘুমিয়েছে শান্তিতে।

কবিতাগুলো পড়তে পড়তে, আবেগের ভিতর মিশকট শহর ও ক্রাইমিয়াতে কাতিয়ার সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টা নিয়ে সে কল্পনা করতে করতে সে ক্রাইমিয়াতে দুইবার চলে গিয়েছিল। এটা কী হতে পারে, এত অপেক্ষার পরেও ফিরে আসবেনা সেই জ্বলন্ত দুপুরটা! সেই গোলাপেরা, করবীরা, সমুদ্রের ঝলকানি নীল সাইপ্রাসেরা? ঈশ্বর কি বঞ্চিত করতে পারে তাকে সেসব সুখ থেকে, যে সুখের ভাবনা কাতিয়াকে ঘিরে;

তোমার কী মনে পড়ে সেই সন্ধ্যা, যখন সমুদ্র গর্জন করছিল
বন‌্য গোলাপের ঝোপে গান গেয়েছিল বুলবুলি
সাদা বাবলা গাছের সৌরভময় শাখাগুলি
তোমার কাছে এসে নুয়ে যাচ্ছিল?

উত্তরহীন প্রশ্নগুলি তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, ম্লান করে দিচ্ছিল। তার নিজেকে এত বোকা মনে হচ্ছিল যে, তার মাথাটা নুয়ে আসছিল। তার হৃদয় গলে যাচ্ছিল দুঃখে, এবং একই সাথে তা পরিপূর্ণ হয়ে উঠছিল মধুরতায়। তার ভিতরে এমন কিছু একটা উঠে আসছিল, যা অশুভ, নির্দয়, আবেগময় ও শক্তিশালী মারাত্মক প্রতিজ্ঞাময়।

হাঁসেরা ডানা ঝাপটাচ্ছে
শান্ত জলে তাদের পাখার ঝাপট
নদীর জলে ঢেউ
আসো, তারারা জ্বলছে
পাতারা মৃদু ভাবে দুলছে
আর মেঘগুলো হচ্ছে একত্রিত।

চলবে