অধ্যায় ১১
দেশের বাড়িতে আসার প্রথম সপ্তাহেই মিতিয়া তার এখানে আসার যথার্থতার প্রমাণ পেল। সে আনন্দের সঙ্গে দেখল, এখন তার প্রিয় বসন্ত ঋতু চলছে। মিতিয়া একটি বই হাতে নিয়ে বসার ঘরের জানালার কাছে বসে ছিল। উদাস নয়নে তাকিয়ে দেখছিল, তার বাড়ির সামনের জমিতে দেবদারু ও পাইন গাছের গুড়ির কাছ দিয়ে প্রবাহিত নোংরা জলধারা, যা মাঠ পার হয়ে পাহাড়ের পেছনের গ্রামের দিকে যাচ্ছে। পাশের বাগানে শত বছরের পুরানো বার্চ গাছে পরিপূর্ণ সুখে অক্লান্তভাবে কা-কা করে যাচ্ছে দাঁড় কাকেরা, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। এই দাঁড় কাকেরা বসন্তের আগমনের অপেক্ষায় থাকে। বসন্ত যেন তাদের উৎসবের ডালি খুলে দেয়। যে ঢাল নিচের দিকে বয়ে গেছে, সেখানেই আছে গ্রাম। কিন্তু সেখানে কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই। সেখানে কেবলই রুক্ষতা। যদিও উইলো গাছেরা হলুদ পাতায় ছেয়ে আছে। মিতিয়া বাগানে গেল। বাগানে আলো ছিল, কিন্তু নিষ্প্রাণ, খর্বাকার হয়েছিল। সমতল জমিটা ছিল সবুজ, ফিরোজা নীল ফুলে আকীর্ণ। রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ের পাতারা আছে। বাগানের দক্ষিণ দিকে ও নিচের দিকে চিড়ে যাওয়া গিরিখাতের কাছে একটি চেরি ফলের বাগান আছে। সেই গাছগুলোতে সাদা সাদা ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে। মিতিয়া গমের ক্ষেতের দিকে গেল। ক্ষেতগুলো ছিল খালি ও ধূসর। ফসল কাটার পর যে খড়গুলো ছিল তা দেখাচ্ছিল চুল আঁচড়াবার চিরুনির মতো। শুকনো পথটি ছিল এবরো-থেবরো আর পাশের ঝোপগুলো বেগুনি দেখাচ্ছিল। যখন যৌবনের এই প্রত্যাশার সময়, তখন সবকিছুতেই ছিল রিক্ততা। কিন্তু তাহলেও সে সর্বত্রই কাতিয়াকেই খুঁজে পাচ্ছিল। সবকিছুতেই তার দৃষ্টি ছিল, কিন্তু তা ছিল ভাসা ভাসা। তার চোখে পড়েছিল যে মেয়েটি তাদের জমিদারিতে কাজ করতে আসে তার দিকে, বাইরের ঘরে যে কর্মচারীরা কাজ করছিল তাদের দিকে। তার হাঁটার দিকে, তার পড়াশোনা ও গ্রামের চেনা লোকদের দেখা দেওয়া, তার মায়ের সঙ্গে আলাপচারিতার দিকে। যে সর্দারটি একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ও স্বভাবে বর্বর, যার সঙ্গে সে ড্রক্সিতে অভিযান চালিয়েছিল সে দিকেও তার দৃষ্টি এড়ায়নি।
আরো এক সপ্তাহ পার হল। সারারাত মুষলধারে বৃষ্টির পর, ঠিক সকালেই উষ্ণ সূর্যটা হঠাৎ প্রচণ্ড শক্তি একত্রিত করে আবির্ভূত হল। এই পরিবর্তনটি হচ্ছিল দিনের পর দিন নয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টায়। জমিগুলো কর্ষিত হচ্ছিল ফসল বোনার জন্য। সেই কর্ষণে খাড়া হয়ে থাকা জমির খড়গুলো জমির সঙ্গে মিশে কালো ভেলভেটের মতো হয়েছিল। পথগুলো সবুজ রঙে রঞ্জিত হলো। ঘন হয়ে উঠল উঠানের ঘাসগুলো, আকাশের নীল হলো আরো গভীর, আরো উজ্জ্বলতর। বাগানও তরতাজা শ্যামলীমায় উদ্ভাসিত হয়ে মন ভরিয়ে দিল। ধূসর লাইলাকের ঝোপগুলো ধারণ করেছিল লাল রং আর চারদিকে ছড়াচ্ছিল সৌরভ। পথের উপর পড়ে থাকা কালো উজ্জ্বল সবুজ পাতার উপর যেখানে আলো পড়েছে, সেখানে ভিড় করেছে উজ্জ্বল ধাতব নীল পাখার কালো মাছিরা। আপেল ও নাশপাতি গাছগুলো এখনও দৃশ্যমান, প্রচুর ফুলের সমারোহ পেরিয়ে, হালকা ধূসর পাতার ছোঁয়া সেখানে লাগেনি। পাতার স্থানগুলো ভরে আছে ফুলে। গাছের ডালপালাগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে যেন নৃত্য করে চলেছে। আপেল ও নাশপাতি গাছের ডালপালাগুলো অন্যান্য গাছের নিচ দিয়ে বেয়ে গেছে, এবং ওদেরকে মনে হচ্ছে যেন দুধসাদা রঙের তুষার। প্রতিদিন ফুল ফোটার পর ওরা আরো সাদা ও ঘন হচ্ছে, আর মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে।
এই অপুর্ব সময়ে, মিতিয়া যখন প্রাণভরে দেখছে তার চারপাশে বসন্তের আনন্দপূর্ণ আবির্ভাব, তখনও কাতিয়া তার হৃদয়ে বিবর্ণ হয়ে তার কাছ থেকে দুরে সরে যায়নি। বিপরীতভাবে, বসন্তের সৌন্দর্যের সঙ্গে, আকাশের নীল থেকে গভীরতর নীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাতিয়া যেন তার হৃদয়ে আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছিল।
অধ্যায় ১২
সন্ধ্যার পূর্বে রোদ ঝলমলে বিকালের দিকে মিতিয়া তার রুমে চায়ের সামোভারের কাছে এসে দেখল চিঠিটি, যার জন্য সকাল থেকে সে বৃথাই অপেক্ষা করছিল। সে দ্রুত দৌড়ে টেবিলটির কাছে গেল। অনেকদিন আগে সে যে কাতিয়াকে চিঠি লিখেছিল, আজ নিশ্চয়ই তারই উত্তর এলো। তার চঞ্চল চোখ চমৎকার খামটির উপর অতি পরিচিত ছোট্ট হাতের লেখাটি দেখল। চিঠিটি হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে, বাগান পেরিয়ে পথের দিকে, বাগানের দূরের কোণে যে খাদের দিকটা ঢালু হয়েছে সেই শেষ প্রান্তে। সেখানে সে থামল, তাকিয়ে দেখল চারদিক, এবং খুব দ্রুত খামের মুখটা ছিঁড়ে ফেলল। চিঠিটা খুবই ছোট, মাত্র কয়েক লাইনের, কিন্তু মিতিয়া এতই উত্তেজিত ছিল যে চিঠিটা বোঝার আগেই সে সাত থেকে আট বার পড়ে ফেলল। তার বুক ধড়ফড় করছিল খুবই দ্রুতগতিতে। ‘আমার একমাত্র ভালবাসা!’ -এই সম্বোধনটাই সে বারবার পড়ছিল যে বাক্যের শেষের বিস্ময়সূচক চিহ্নটির প্রভাবে তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা তার পায়ের তল থেকে সরে যাচ্ছে। সে উপরের দিকে তাকাল। বাগানের উপরে আকাশটাকে মনে হল বিজয়ী এবং উজ্জ্বল, চারদিকে ধবল সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত রয়েছিল চারদিক, দূরের ঝোপের সবুজ পাতাগুল্মের ভেতর সুর ধরেছে একটি বুলবুল পাখি, রাতের আগের হালকা শীতের ভেতর, তার সুরটি যেন প্রার্থনার মতো স্পষ্ট, পরিষ্কার ও জোরালো। মিতিয়ার পাণ্ডুর মুখে রক্ত প্রবাহ বেড়ে যেয়ে রক্তিম হয়ে উঠল এবং মাথার মধ্যেও একটি স্নায়বিক উত্তেজনা বোধ হল।
সে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরে এলো। তার হৃদয় উপচে পড়েছিল ভালোবাসায়, সুখের পেয়ালা ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। এর পরের দিনগুলোতে সে চিঠিটি নিয়ে চলাফেরা করছিল খুব সাবধানে। প্রেমিকের চিঠি পাওয়ার কিছুটা অহঙ্কারও ছিল। আর ছিল পরবর্তী আরেকটি চিঠি পাওয়ার প্রত্যাশা। চলবে