দেশে ফেরার পর সপ্তাহের প্রথমদিকগুলোতে মাত্র একবারই কাতিয়ার স্মৃতি তার কাছে ভেসে এসেছিল, তাও খুব অপ্রীতিকরভাবে। এক ঘোর সন্ধ্যায় কাতিয়ার শরীরের স্বপ্ন দেখে দেখে মিতিয়া উত্তেজিত হয়েছিল। কাতিয়াকে নিয়ে তার শরীরী ভাবনাই কাতিয়াকে মিতিয়ার কাছে টেনে আনে। উত্তেজিত অবস্থাতেই সে বাড়ির পিছনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন বেশ গাঢ় অন্ধকার, চারদিক শান্ত ও নিরিবিলি, নাকে এসে লাগছিল ভেজা মাঠের গন্ধ। বাগানের অসমান গাছের চূড়ার ফাঁক দিয়ে গাঢ় অন্ধকারের ভেতর আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো কান্নার আবহে জ্বলছিল। হঠাৎ করে দূর থেকে বন্য কিছুর পৈশাচিক গর্জন শোনা গেল। এমন নয় যে একবার হয়েই থেমে গেল। সেই ঘেউ ঘেউ গর্জন অনবরত চলছিল। মিতিয়া কাঁপছিল, নিজেকে ধরে রাখছিল শক্ত করে। কম্পমান অবস্থায় সে সাহস সঞ্চয় করে অন্ধকার গলির পথ ধরে সাবধানে এগোতে লাগল। যেখান থেকে অশুভ চিৎকার আসছিল সেদিকে গিয়ে সে অপেক্ষা করছিল, আর শুনে বোঝবার চেষ্টা করছিল চিৎকারগুলো কোন দিক থেকে আসছে। ‘তাহলে কি কোনো পেঁচা-দম্পতি নিজেদের মধ্যে প্রেম করছে!’ আর কিছুই না! নিজের মনে মিতিয়া এই কথাই ভাবছিল। তারপরও গভীর অন্ধকারের ভেতর কোনো অশুভ আত্মা দাঁড়িয়ে আছে ভেবে মিতিয়া দাঁত চেপে শক্ত হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তখনি খুব কাছে নিচুস্বরে একটি গর্জন শোনা গেল। আর এই শব্দ শুনে মিতিয়ার সাহস যেন তলানিতে এসে পৌঁছাল।
মিতিয়া পথের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল। আওয়াজটাও মনে হচ্ছিল খুব কাছের, কর্কশ, মর্মরধ্বনির মতো। অশুভ আত্মাটা মনে হয় বাগানের অন্যদিকে সরে গেল। সেখানে সে কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করল, তারপর কিছুক্ষণ শিশুর মতো বিলাপ, গোঙানি ও কান্না করল। তারপর ব্যথাজনিত কারণে কিছুক্ষণ ডানা ঝাপটানো ও দুঃখ-আনন্দ মিশ্রিত বিকট চিৎকার করছিল। ঠিক পরক্ষণেই সুড়সুড়ি ও ব্যঙ্গমিশ্রিত হাসিতে ফেটে পড়ছিল। সমস্ত শরীর কাঁপছিল মিতিয়ার। সব অন্ধকার ভেদ করে সে ওখানে যেয়ে দেখতে চাইছিল আসলে ওখানে কী ঘটছে। কিন্তু সেই অশুভ আত্মা হঠাৎ গগনবিদারী হতাশাজনিত চিৎকার করে তখনই বাগান থেকে এমনভাবে উধাও হয়ে গেল, যেন মনে হচ্ছিল পৃথিবী তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। এরকম কামুকতাপূর্ণ ভৌতিক কাণ্ড আবার ঘটবে মনে করে মিতিয়া কিছুক্ষণ বৃথাই অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে গেল। পুরো রাতটাই তার কেটেছিল আতঙ্কজনক চিন্তার মধ্যে। ৯ মার্চের বিষাদ ও বিষাদময় কল্পনা তাকে পেয়ে বসেছিল। তার চিন্তায় ফিরে ফিরে আসছিল ওইসব। তার চিন্তায় এল, ‘কাতিয়া এখন কোথায় আছে? নিশ্চয়ই সে অন্য কারো সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছে।’
যাইহোক, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রাতের যন্ত্রণাময় ভাবনাগুলো হঠাৎ করে হাওয়া হয়ে গেল। তার মনে পড়ল মস্কো ছেড়ে আসার সময় কাতিয়ার সেই অশ্রুসজল চোখ। কাতিয়ার উৎসাহ নিয়ে বলা সেই কথাগুলো, জুনের শুরুতে ক্রাইমিয়াতে তার সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা। বিদায়বেলার প্রস্তুতিতে কত মধুরভাবে তাকে সহায়তা করেছিল কাতিয়া এবং রেলস্টেশনে এসে কত চমৎকারভাবে তাকে বিদায় জানিয়েছিল। কাতিয়ার একটি ছবি বের করল সে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল তার ছোট্ট ককেশিয় মুখের দিকে। কী আশ্চর্য বিশুদ্ধ এই চেহারা, কত স্বচ্ছ চোখ দুটো, উজ্জ্বল, ভাসাভাসা আর গোলাকৃতির। পারস্পরিক ভালোবাসার উপর বিশ্বাস রেখে, সে কাতিয়াকে একটি দীর্ঘ ও প্রেমপূর্ণ চিঠি লিখল। তারপর চিঠি পোস্ট করার পর ভাবতে থাকল, তাদের একসাথে থাকা আগামী দিনগুলো কতটা না ভালোবাসায় উজ্জ্বল ও রঙিন হয়ে উঠবে।
মিতিয়া তখনো ভোলেনি, ঠিক নয় বছর আগে যখন তার বাবা মারা যায়, তখন তার কেমন লেগেছিল। সেটি ছিল বসন্তের একদিন। মৃত্যুর পরদিন অভিজাত পোশাকে সাজিয়ে তার বাবাকে বড় একটি টেবিলে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তার মলিন হাতদুটো দুদিক থেকে বুকের উপর ক্রস করে রাখা ছিল। তার মুখের দাড়ি ছিল কালো আর পাতলা, নাক ছিল ধবধবে সাদা। মিতিয়া ভয় ও দ্বিধার ভেতর দিয়ে সেই রুমটি পার হয়ে সিঁড়ির উপরে উঠে দরজার সঙ্গে হেলানো সোনালি জরির ঢাকনা দেয়া বিশাল কফিনের উপরিভাগটুকু দেখেছিল। সেদিনই প্রথম সে মৃত্যুর বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছিল। তার মনে হচ্ছিল সর্বত্রই মৃত্যু, সূর্যকিরণে, উঠানের সবুজ ঘাসে, আকাশে এবং বাগানে। মিতিয়া বাগানের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল লেবু গাছের সারির ভেতর দিয়ে চলছিল, তারপর পাশের পথগুলিতে হাঁটল। সে দেখল গাছগুলোকে, সাদা প্রজাপতিদের এবং শুনল পাখিদের ডাক। কিন্তু কোনো কিছুই যেন তার পরিচিত মনে হচ্ছিল না। মৃত্যু ছিল সর্বত্রই, বিশাল কক্ষের ভীতিকর টেবিল থেকে শুরু করে কফিনের উপর জরির ঢাকনাসহ সিঁড়ি পর্যন্ত। সূর্যের কিরণ এখন অনুজ্জ্বল, ঘাসেরা হারিয়েছে সজীবতা, প্রজাপতিরাও তাই। চব্বিশ ঘণ্টা আগে যা ছিল উষ্ণতার মায়ায় ঢাকা, এখন তা আর নেই। মনে হয় যেন তার শেষ সময়ে সে পৌঁছে গেছে। বসন্তের সৌন্দর্য ও তার শাশ্বত যৌবন এখন আনন্দহীন। এই অনুভব দীর্ঘদিন থেকে গিয়েছিল। প্রতিটি বসন্তে এই অনুভব ফিরে ফিরে এসেছিল, আর যখনই সে শুঁকত, সেই মিষ্টি দুর্গন্ধ বিবমিষার মতো ফিরে এসেছিল।
এই মৃত্যুভয় তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, কিন্তু এই বসন্তে তা যেন একটু ভিন্নভাবে ফিরে এল। তার প্রথম প্রেমের বসন্ত যেন অন্য সব বসন্ত থেকে আলাদা। তার ভুবনে আবারো পরিবর্তন এসেছে, তবে এখানে ভয়ের কিছু নেই, প্রতিকূলতার কিছু নেই। তবে বিপরীতভাবে আছে শুধু বসন্তের আনন্দ আর যৌবনের জয়গান। এই বসন্ত ভরে উঠেছে কাতিয়ার ভালোবাসায়, আরো স্পষ্ট করে বললে কাতিয়াকে চাওয়ার আকুলতায় রয়েছে সেই সৌন্দর্য। কাতিয়ার কাছ থেকে ভালোবাসা নিশ্চিত করার এই অভিজ্ঞতা মানব জীবনের সকল সুন্দর অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে যায়। যতই বসন্তের দিন এগিয়েছে ততই মিতিয়া কাতিয়াকে আরো বেশি করে চেয়েছে। কাতিয়া এখন কাছে নেই, শুধু তার ছবিই আছে তার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের জন্য। সে ভাবছে কাতিয়ার প্রতি তার সরল চাওয়া ও সুন্দর শারীরিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের মধ্যে কোনো দোষ নেই। এই চাওয়া নির্দোষ, এই চাওয়া সুন্দর। মিতিয়া যা কিছু করে, যেখানেই যায়, সে যেন কাতিয়াকে আরো গভীর থেকে গভীরতরভাবে অনুভব করতে থাকে। চলবে