ইয়োহান ভল্ফগাং ফন গ্যোটে (২৮ আগস্ট ১৭৪৯–২২ মার্চ ১৮৩২) জার্মান কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী ও কূটনীতিবিদ। তাকে আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ জার্মান সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্যোটের সেরা সাহিত্যকীর্তি ‘ফাউস্ট’ হলেও তার ‘দ্য সরোস অব ইয়াং ওয়ার্থার’ প্রকাশের ২৫০ বছর পূর্তি ও এর প্রভাব আলোচিত হয়েছে।
এবছর সেপ্টেম্বরে জার্মান লেখক গ্যোটের বিখ্যাত ও বিতর্কিত উপন্যাস ‘ডাই লেইডেন দেস জুংজেন ওয়ার্থার’ প্রকাশের ২৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে ‘দ্য সরোস অব ইয়াং ওয়ার্থার’ নামে।
এটি একটি আধা-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, গ্যোটে এটি লিখেছেন একজন তরুণ ও আদর্শবাদী শার্লট বাফের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে।
উপন্যাসের ওয়ার্থার এমনই চরিত্র যে লেখককে ভূতের মতো কাল্পনিক কবর থেকে তাড়া করে বেড়ায়।
‘দ্য সরোস অব ইয়াং ওয়ার্থার’-কে বলা যায় একটি অপ্রত্যাশিত প্রেমের চিঠি-উপন্যাস। ওয়ার্থার তার বন্ধু উইলহেমকে চিঠি লেখে, যার মধ্যদিয়ে তার সংবেদনশীল এবং শৈল্পিক মনের পাশাপাশি তার আবেগপ্রবণ মেজাজ প্রকাশ পায়।
গল্পে ওয়ার্থার শার্লটের সাথে দেখা করে এবং প্রেমে পড়ে যায়। শার্লট সুন্দরী যুবতী হওয়া সত্ত্বেও বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে ছোট ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে।
শার্লট অ্যালবার্টের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে নিয়েছে।
ওয়ার্থারের চিঠিতে প্রেমের করুণ রসের পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে ওয়ালহাইমের সুন্দর গ্রাম এবং গ্রামীণ জীবনের সরলতা, ভদ্রসমাজের কৃত্রিমতা ও রাজনীতি।
কাহিনি অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে ওয়ার্থার অপূর্ণ প্রেমের অত্যাচারে ক্লান্ত। এক রাতে অ্যালবার্টের অনুপস্থিতিতে ওয়ার্থার নিজের আবেগ সংবরণ করতে পারে না, তিনি শার্লটের কাছে নিজের ভালোবাসার কথা বলে তিরস্কৃত হয়।
পরেরদিন সকালে ওয়ার্থারকে তার গবেষণাগারের মেঝেতে রক্তাক্ত পাওয়া যায়। তার পরের রাতে তাকে তার প্রিয় স্থানে সমাহিত করা হয়, যেখানে শার্লট বা অ্যালবার্ট বা কোনো পাদরি কেউই উপস্থিত ছিলেন না।
গ্যোটের এই উপন্যাসটি তার সময়ের একটি স্মারক। এটি জার্মান প্রোটো-রোমান্টিক আন্দোলনের মূল উদাহরণ যা ‘স্টর্ম উন্ড ড্র্যাং’ বা ‘ঝড় এবং চাপ’ নামে পরিচিত। যা চিরায়ত এবং রেনেসাঁর যুক্তিবাদী নীতির উপর ব্যক্তিবাদ, প্রেরণা এবং আবেগকে মূল্যায়িত করেছে।
তরুণ ওয়ার্থারের দুঃখ অবশ্যই পাঠকদের হৃদয়ে দুঃখবোধ তৈরি করেছে। যা তার আত্মহত্যাকে আবেগপ্রবণ করে তোলে, যাকে এখনো ১৮ শতকের পাপী, অপরাধী এবং কাপুরুষতা হিসেবে নিন্দা করা হয়।
ওয়ার্থারের মৃত্যুর সাথে সংবেদনশীলতা একটি প্রশংসনীয় গুণ না হয়ে একটি প্যাথলজিক্যাল অতিসংবেদনশীলতায় রূপান্তরিত হয়, অথবা শার্লটের ভাষায় ‘সবকিছুর সাথে খুব উষ্ণ সহানুভূতি’ বলে চিহ্নিত। এই কারণে গ্যোটের অনুভূতির এই মানুষটি সহানুভূতির মতোই তিরস্কৃতও হয়েছিল।
‘দ্য সরোস অব ইয়াং ওয়ার্থার’ বিশ্বব্যাপী বেস্টসেলার হয়ে উঠেছিল। ১৭৭৫ সালে ফরাসি এবং ১৭৭৯ সালে ইংরেজিতে অনূদিত হয়।
শিল্পী-সাহিত্যিকেরা ওয়ার্থারের ভাগ্যের পুনপরিকল্পনা করার জন্যই আকৃষ্ট হন। এমনকি জেন অস্টেনের ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ এবং মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’সহ অনেক রোমান্টিক উপন্যাসে ওয়ার্থারকে একটি সাংস্কৃতিক রেফারেন্স হিসাবে পাওয়া যায়।
উইলিয়াম গডউইনের প্রয়াত স্ত্রী এবং মেরি শেলির মা মেরি ওলস্টোনক্রাফ্টের স্মৃতিচারণ ও তার আত্মহত্যার প্রচেষ্টার জন্য তাকে ‘মহিলা ওয়ের্থার’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
এমনকি নেপোলিয়নেরও এই উপন্যাসটির ভক্ত ছিলেন। ১৮০৮ সালে ফরাসি সম্রাট যখন গ্যোটের সঙ্গে করেন তখন তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি উপন্যাসটি সাতবার পড়েছেন।
ওয়ার্থারিয়ান তরুণরা ওয়ের্থারের ট্রেডমার্ক হলুদ কোট, নীল জ্যাকেট এবং উঁচু বুট পরে দুঃখের অশ্রুজমিতে প্যারেড করবে।
এই স্ট্যাইলটি আত্মঘাতী সংবেদনশীলতায় পরিণত হয়েছে, যার সেন্টিমেন্টাল বা রাজনৈতিক যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন।
ফ্যান, দস্তানা, গহনা ও দামি চীনামাটির বাসনপত্র এবং চীনের স্মৃতিচিহ্নসহ ফ্যাশনের অনুসঙ্গগুলোতে ওয়ের্থার এবং শার্লটের দেখাও মেলে। মহিলারা সুগন্ধি ‘ইউ ডি ওয়ার্থার’ ব্যবহার করে।
উপন্যাসের বিভিন্ন সস্তা অনুভূতিমূলক দৃশ্য চিত্রিত হয়ে ইউরোপে বিপুলভাবে প্রচারিত হয়েছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ওয়ের্থারের সমাধিতে একজন তরুণ এবং সুন্দরী শার্লটের শোকের চিত্র, যা উপন্যাসে কখনো ঘটেনি।
এই ধরনের চিত্রগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে উপন্যাসটি তার কাল্পনিক বর্ণনার সীমা ছাড়িয়ে একটি নিজস্ব জীবন পেয়েছিল।
চার্লস মুর ‘ফুল ইনকোয়ারি ইন দ্য সাবজেক্ট অব সুইসাইড’-এ আত্মহত্যার কাল্পনিক চিত্রের উপর সম্পাদনায় শোক প্রকাশ করেছেন, ওয়ার্থাকে প্রায়শই ‘কাল্পনিক নয়, একটি বাস্তব চরিত্র হিসাবে’ পড়া হয়েছিল। যেন একটি সত্য ঘটনা। তিনি বলেছেন, এটি ‘আরো মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং দুষ্টুমি বাড়ায়।’
আসলেই দুষ্টুমি! সত্যি বলতে ইউরোপ ওয়ার্থারম্যানিয়ার খপ্পরে পড়েছিল, কপিক্যাটরা ব্রিটেন এবং মহাদেশ জুড়ে তার আত্মহত্যার অনুকরণ করে। বেশ কয়েকটি দেশের সংবাদপত্র থেকে জানা গেছে যে, লোকেরা ওয়ের্থারের ট্রেডমার্ক পোশাক পরে আত্মহত্যা করেছে এবং কাছাকাছি গ্যোটের উপন্যাসের একটি অনুলিপি পড়ে ছিল।
কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ লাইপজিগে উপন্যাস এবং ওয়ার্থারের পোশাকের ধরন উভয়ই নিষিদ্ধ করেছিল। আত্মঘাতী সংক্রামক রোগের বিস্তার বন্ধ করার প্রয়াসে ডেনমার্ক এবং ইতালিতেও উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বহু বছর পরে এই উন্মাদনা ঔপন্যাসিক মাদাম ডি স্টেলকে ব্যঙ্গ করেছে ওয়ার্থার ‘বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলার চেয়ে বেশি আত্মহত্যার কারণ হয়েছিল।’
২০ শতকের শেষের দিকে, কপিক্যাট আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার জন্য উপন্যাসের খ্যাতি একটি সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
১৯৭৪ সালে উপন্যাসটি প্রকাশের ২০০ বছর বছর পরে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড পি. ফিলিপস নিউ ইয়র্ক টাইমসে আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ‘ওয়ের্থার প্রভাব’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
পরবর্তী দশকগুলোতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মাইন্ডফ্রেমের মতো সংস্থাগুলোকে কীভাবে ওয়ের্থারের মতো ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে নির্দেশিকা তৈরি করতে বলে।
এই উদ্বেগ সত্ত্বেও, গ্যোটের ওয়ার্থার সৃজনশীল এবং জনপ্রিয় কল্পনায় বেঁচে আছে। মার্ক ওয়েবের ‘ফাইভ হানড্রেড ডেস অব সামার’-এর রোমান্টিক লিড টম হ্যানসেনের মধ্যে ওয়ার্থাকে চেনা যাবে, যার বিষণ্নতা ওসিয়ানের কবিতার চেয়ে স্মিথের সঙ্গীত দ্বারা প্রভাবিত।
সম্প্রতি ‘ইয়ং ওয়ার্থার’ একটি কানাডিয়ান রোমান্টিক কমেডি এবং হোসে লরেনকো দ্বারা পরিচালিত টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়েছে৷
কিন্তু এটা কেনো আশ্চর্য? ওয়ার্থারের মৃত্যুর সমস্ত কালিমা সত্ত্বেও এই গল্পটি একইভাবে আনন্দদায়ক এবং বেদনাদায়ক চিরন্তন থিমের নিরবধি উপস্থাপনা।
সূত্র : ইন্টারনেট ও অর্থডক্সি