‘কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন’ : পাঠ-প্রতিক্রিয়া

কুসতুনতুনিয়া’ নামটি বড়ই অদ্ভুত, ঘাবড়ে যাওয়ার মতো; আমিও গিয়েছিলাম। পরে যখন আসল রহস্য জেনেছি তখন পুলকিত না হয়ে পারিনি।

কুসতুনতুনিয়া’ নামটি এসেছে ‘কনস্টান্টিনোপল’ থেকে, যার আরেক নাম ইস্তাম্বুল। এই কনস্টান্টিনোপল ছিল সেই প্রাচীনকাল থেকে সুদীর্ঘকাল রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী, এবং ধনে-মানে সবদিক দিয়ে জগদ্বিখ্যাত। আরবরা তাদের উচ্চারণের আড়ষ্টতার কারণে তাকে বলতো ‘কুসতুনতুনিয়া’। স্বয়ং নবি মুহাম্মদ (স.) মুসলিম যোদ্ধাদের প্রতি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “অবশ্যই তোমরা একদিন ‘কুসতুনতুনিয়া’ জয় করবে...”।

সেই কুসতুনতুনিয়া ভ্রমণের কাহিনি লিখেছেন মুহম্মদ মুহসিন। তবে এই ভ্রমণকাহিনিকে তিনি শুধু এই কুসতুনতুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপল বা ইস্তাম্বুল শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তা ছড়িয়েছেন তুরস্কের আরো বেশ কয়েকটা উল্লেখযোগ্য শহর ও টুরিস্ট স্পটের মধ্যে।

লেখকের ভাষা সরল, সাবলীল, গতিময় ও সৌকর্যপূর্ণ। মাঝে মাঝে হিউমার ছড়িয়ে করেছেন আরও উপাদেয়। পায়েসের মধ্যে কিছু বাদাম বা কিশমিশ জাতীয় বস্তু ছড়িয়ে যেমন পায়েসের স্বাদ বৃদ্ধি করা হয়, তার লেখায় হিউমার সেই কাজটি করেছে।

নিজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক হওয়ার সুবাদে এই সাহিত্য থেকে লেখক মাঝেমধ্যেই রেফারেন্স টেনেছেন, এবং তার মাধ্যমে আলোচ্য বিষয়কে আরো প্রাসঙ্গিক, সুস্পষ্ট এবং উপাদেয় করে তুলেছেন। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা এতে খানিকটা বাড়তি আনন্দ পাবে।

শুধু তাই নয়, যে কুসতুনতুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপলকে লক্ষ্য করে লেখকের এই ভ্রমণ, সেই নামটিরও ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের কাছে একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই নাম। এই শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৬/৭ শ বছর আগে। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ রোমান সম্রাট দ্বিতীয় কনস্টানটাইনকে হারিয়ে এই শহর দখল করে নেন এবং অটোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটান। আর খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা এই শহর ত্যাগ করে ইউরোপের নানা শহরে ছড়িয়ে পড়েন এবং সঙ্গে করে নিয়ে যান তাদের যাবতীয় বই-পুস্তক। আর তাতেই ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পালে হাওয়া লাগে।

সুতরাং এই শহরের কাহিনি ও ইতিহাস যে সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের আগ্রহের বস্তু হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়াও, এই বইয়ে আছে এমন একটি অধ্যায় যেখানে লেখক মহাকবি হোমার রচিত ‘ইলিয়াড’-এর সেই পৌরাণিক ট্রয় নগরী ভ্রমণের কাহিনি রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেছেন। যদিও এই নগরী শুধুই একটা পৌরাণিক নাম, বাস্তবে যার অস্তিত্ব মেলা ভার, তবুও সেই শহরকে দেখতে যাওয়ার মধ্যে কৌতুক আছে বৈকি। তার সাথে যুক্ত নানান নাম-ধাম ও মিথ নিয়ে সেই কাহিনিকে তিনি সরস করে তুলেছেন।

শেষমেষ সেই মহাকাব্যের কয়েকটি চরিত্রের কথোপকথনের প্রসঙ্গ টেনে তার সেই ভ্রমণ-বর্ণনার মধ্যে খানিকটা করুণ রসেরও সঞ্চার করেছেন। সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা যে এতে আনন্দ পাবে, এবং তাদের পূর্ব পঠিত ইলিয়াডের সেই অমর কাহিনির কিছু কিছু স্মৃতি যে রোমন্থন করে নিতে পারবে তাও বলা যায়।

এসবের সাথে লেখক তার দেখা প্রতিটি ট্যুরিস্ট স্পটের অনুপূঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। তুলে এনেছেন সেইসব স্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট মিথ, জনশ্রুতি ও ইতিহাস। সংযুক্ত করেছেন নিজের মন্তব্য। প্রতিটি স্পটে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি দিয়েছেন পথ, খাবার ও নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা। আর এর মধ্য দিয়ে পাঠকের জন্য ছড়িয়েছেন প্রচুর আনন্দ।

তবে বইটি পাঠান্তে পাঠকের মনে হতেই পারে, কোথায় যেন একটু ঘাটতি থেকে গেছে। তুর্কিদের কালচার, তাদের মনস্তত্ত্ব, তাদের জীবনযাপনের ধরন, তাদের অর্থনীতি-রাজনীতি এমন নানান দিক অবহেলিত হয়েছে। কিন্তু যখন আমলে নেওয়া হবে যে, লেখকের এই ভ্রমণ ছিল মাত্র ১৫ দিনের, আর এই স্বল্প ভ্রমণে এতকিছুর দিকে নজর দেয়া যেকোনো লেখকের পক্ষেই দুঃসাধ্য ব্যাপার।

 

কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন : মুহম্মদ মুহসিন; প্রকাশক : বাউণ্ডুলে; মূল্য : ৩৬০; প্রথম প্রকাশ : ২০২৪।