উপন্যাস কথা বলে বিগত সময়ের, উপন্যাস কথা বলে আগত সময়ের। আগত সময় নিয়ে মানুষের আগ্রহ যেমন, ঠিক তার বহুগুণ আগ্রহ নিয়ে মানুষ বিগত সময়কে বুঝতে চায়—অতীত সময়কে ধারণ করার চেষ্টা করে। আর সেই অতীতকে সুনিপুণ গদ্যশৈলীতে ধারণ করেছেন জার্মান ঔপন্যাসিক জেনি এরপেনবেক তার ‘কাইরোস’ উপন্যাসে।
উপন্যাসের পটভূমি কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানি। উপন্যাসটি শুরু হয়, ক্যাথারিনা নামক এক নারীর প্রাক্তন প্রেমিকের (হ্যান্স) মৃত্যু সংবাদ শোনার মধ্য দিয়ে। এই দুঃসংবাদের সাথে ক্যাথারিনার এপার্টমেন্টে এসে পৌঁছায় প্রেমিকের ছোটখাটো নোট, চিঠিপত্র সংবলিত কিছু বাক্স। বাক্সগুলো খোলা নিয়ে প্রাথমিকভাবে দ্বিধায় ভুগলেও অবশেষে বাক্সগুলো খোলার সাথে সাথে খুদে বুনো পুষ্পের মতো তার স্মৃতিতে প্রস্ফুটিত হতে থাকে অতীত স্মৃতিগুলো।
তাদের প্রথম দেখা হয় ১৯৮৬ সালে, পূর্ব জার্মানিতে। তখন ক্যাথারিনার বয়স মাত্র ১৯ বছর। অপরদিকে তার প্রেমিক হ্যান্স ৫৮ বছর বয়সি বিবাহিত পুরুষ ও এক পুত্র সন্তানের পিতা। সে একজন সফল লেখকের পাশাপাশি রেডিও প্রেজেন্টরও। দুজনের এই সম্পর্ক সময়ের সাথে এমন এক জাল বুনতে থাকে— যা কেবল মনকেই না বরং মননেও প্রভাব বিস্তার করে।
ক্যাথারিনা টাইপ রাইটারের চাকরি ছেড়ে থিয়েটার কোম্পানিতে যোগদান করার পর থেকে তাদের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। নতুন কর্মস্থলে ভাদিমের সাথে সে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে— যা প্রেমের তুলনায় ক্যাথারিনার মনে অনুতাপ-ই বেশি সৃষ্টি করে। অনুতাপ থেকে তার মধ্যে ক্রিয়া করে, সে তার সমস্ত চুল কেটে ফেলে। হ্যান্স এসব সত্য জানতে পেরে ব্যথিত হয়—তাকে ক্যাথারিনার প্রতি কঠোর করে তোলে। উপন্যাসের পরতে পরতে পাঠকরা তা অনুভব করতে পারে। অতঃপর পাঠক মুক্তি চায় ক্যাথারিনার; অনেকটা তৎকালীন জার্মানির সাধারণ জনগণের মতো।
মনে হতে পারে ‘কাইরোস’ হয়ত অসম বয়সি প্রেমের ব্যক্তিগত কোনো আখ্যান। তবে এখানেই এরপেনবেকের জাদু—তিনি উপন্যাসটিকে ব্যক্তি পর্যায়ে রাখেননি, উপন্যাসটিকে নিয়ে গেছেন রাজনীতি ও ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে। পূর্ব জার্মানিতে বড় হওয়ায় তার উপন্যাসে জার্মানির গল্প, ইতিহাস, রাজনৈতিক উপলব্ধিগুলো স্পষ্টভাবেই ওঠে এসেছে। তার অন্যান্য উপন্যাসের সাথে পরিচয় থাকলে বিষয়গুলো বোধগম্য হয়। ২০১৭ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত ‘GO,WENT,GONE’ উপন্যাসে, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত জার্মান অধ্যাপকের গল্প বলেছেন, যার প্রাত্যহিক কাজকর্ম আলোড়িত করে বার্লিন প্রাচীরের পতন—পাশাপাশি তিনি জার্মানিতে সদ্য আগত শরণার্থীদের জীবনাচরণকেও খুব নাটকীয় ঢঙে উপস্থাপন করেছেন। ২০১৪ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত ‘THE END OF THE DAYS’ উপন্যাসে, ভিন্ন পাঁচটি ঐতিহাসিক সময়ে ভিন্ন পরিচয়ে একটি মেয়ে জন্ম নেয় এবং তৎকালীন রাজনৈতিক আবহমণ্ডলে তার মৃত্যু হয়।
এরপেনবেকের পূর্বের উপন্যাসগুলো থেকে বোঝা যায় তিনি উপন্যাসের অন্তরালে ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসেন। ‘কাইরোস’ এও তিনি সে চেষ্টায় করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। মূলত, উপন্যাসে তিনি পূর্ব জার্মানির শেষ দিকের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন— যেন বার্লিন প্রাচীরের পতনের মধ্য দিয়ে হ্যান্স-ক্যাথারিনার ভালোবাসারও পতন হয়।
এরপেনবেকের সচ্ছল, মার্জিত ও নান্দনিক শব্দ ও শৈলীর কল্যাণে দীর্ঘ উপন্যাসটি পাঠককে শেষ অবধি আটকে রাখে ও নতুন অভিজ্ঞতা প্রদান করে। যা আকৃষ্ট করে বুকার প্রাইজের বিচারকদেরকেও। যার কল্যাণে অনুবাদক মাইকেল হফম্যানের সাথে তিনি বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন এবারের বুকার পুরস্কার।
তথ্যসূত্র :
theguardian.com
commonwealmagazine.org