প্রিয় দশ

পরানী ও মথুরার মাঠ

ও পরানী মথুরার মাঠে বসে তুমি নির্জন
এ পাড়ায় আমি কাদা ছানি
                  যুবককুমার
রাধার মূর্তি গড়ে পেতেছি খেলা

চুলের কাজল দেহ বেয়ে মধ্যরাত নামে
ও পাড়ার কুমারীরা চোখ বোঁজে
                          অলস আঁধার
মায়াময় বাঁশরিতে হিমায়িত ঘুম আনে

ও পরানী মথুরার মাঠে বসে তুমি ভাবছো
পামরী লেগেছে আমার বীজধানে
                           সর্পিল সময়
শুকনো মালঞ্চলতা চেয়ে আছে বর্ষার আশায়

শেষরাতে শাঁখাভাঙা গোঙানিতে বধূ
ফিরে পেল নাগরের পাখিসুর
                      সর্পিনী মেঘ
এভাবে ফেলছে গিলে চিরচেনা চাঁদের শরীর

ও পরানী দেখেছো কি? মথুরার মাঠে বসে তুমি নির্জন
সাঁকোর শরীর এলিয়ে আমি
                     কলমি শাবক
কীভাবে ভেসে আছি নদীজলে, অবলা অনঘ

সখী আমার অন্যের বধূ... চারিদিকে তার ঘর
কানে বাধে শাঁকধ্বনি
                বায়ুসন্তরণ
কে যেন করছে খেলা আমি যে তার অবহেলা
আমি তার ফেলে আসা বেলা

ও পরানী বলে দাও তুমি, আমি কার নির্ঝর
আমি কার পুতুল কোথায় আমার কাদামাখা ঘর


মানুষ ও নিমশ্বাস

থানকুনি শরীর ছুঁয়ে ভোরেরচোখ জ্বলে না এখন
                     জ্বলে কি প্রতীতী পুরাণ?
মনু চাষার ডুবে যাওয়া একটুকরো আবাদী জমি
                     গেয়ে চলে ভাঙনের গান...
কচুরিফুলের বেগুনি সৌরভ পাতিহাঁসের পালকে
স্পর্শ আবেশ মাখে না দিঘির দীঘল জল
                             মাখে কি এখন?
যাকে চিনতাম এতদিন সবুজ মুগ্ধতায়, কাছে গিয়ে কাল
দেখেছি কৃত্রিম চর জেগেছে তার পলিময়ী নদীর ভিতর
এ কেমন ছবি তার এ কেমন সময়!
আসলে জানে না আমার পাখি প্রণয়ী মন
কতটা সময় পার হলে, মানুষ-মানুষ হবে...
                         হবে নিমগাছ... বর্ণিল বনায়ন
চারদিকে উড়ে ঢোলকলমির বিবর্ণফুল... হাওয়ায় ভাসে
ভাঙা ঘাসী নাওয়ের গলুই
উজান গাঙের জলহীন স্রোত ঠেলে আজ
আমি কোন আগামীর দিকে
তাকিয়ে বলবো,
কত সায়র সময় পার হলে মানুষ
মানুষ হবে? পাবে নিমশ্বাস হবে বিচিত্র সবুজ


পুঁথিচিত্রকর

পুঁথিচিত্রকর আমি বৃক্ষবাকল রেখায় রেখায় আপনাকে আঁকি
নিমগ্ন ঘোর লাগা গোরে...তুই মাতামহীর পূর্বসূরি, আমি এক দীনহীন
শামুক মারা নির্দয় শাঁখারী; সৌন্দর্য কিনতে গিয়ে জেনেছি আকাশের
সব পাখিরা পাখি নয়, সব বৃক্ষই হয় না বৃক্ষ-ফলের পরিচয়; কিছু
পাখি কিছু বৃক্ষ একাকার যারা ভালবাসতে জানে, পায় না কিছুই, তারাই
বৃন্দাবন দাস কিংবা চন্দ্রাবতীর চন্দ্রের বাহার, মানুষের মধ্যে মানুষ
প্রকৃত মানুষ থেকে যায়; সৌন্দর্য সৃষ্টিমূলে থাকে কিছু প্রতারণা কিছু বিস্ময়
আর কিছুটা নির্দয়। কে বলে মানুষ কাছে গেলে প্রকৃত পাখি উড়ে যায়?
কিছু অচিন পাখি আছে কিছু অচেনা বৃক্ষ, যারা সব ছেড়ে
শিকড় গাড়ে উড়ে উড়ে বাসা বান্দে মানব হৃদয়


মুনিয়া, দূর-কোন গাঁ

রতিবিহার শেষে জ্যোতি নিভে যায়
অহেতু কোলাহল—তুমি এসে ফিরে গেছ ক্রন্দনরাত
দ্বৈতহৃদয়; রক্তাক্ত ছায়ায় খুঁজে পেয়েছিলাম তোমার প্রণয়

নিদ্রিত চোখকে নিহত ভেবে বাতাস নিয়েছিলে বুকে
চোখের দৃষ্টি জংধরা ছিল সম্মুখে,

মুনিয়া তুমি জানো কি? হয়তো জানো, জানো না...
আরও এক অন্ধকারের প্রস্তুতি শেষে জানি প্রেম মরে না
বিবর্ণ আঘাতে প্রেমিকার। দ্বৈপায়ন বোঝেনি—দ্বৈতহৃদয়
সাগর শৈবালে মিশে আছে ফসিল-প্রণয়
শরীরে শবরীর দ্যুতি ছিল তার,
বোঝেনি এমন জটিল অন্ধকার।
মুহূর্তে মাছের চোখ নিভে যায়
চোরা-স্রোতের ফলায়

আমারও কি মাছেদের মতো চোখ?
মুনিয়া কি শুধুই চোরা-স্রোত
দূর-কোন গাঁ?
তা-না হলে করোটির ভেতর কেন ঢেউয়ের ছোঁয়া।


জন্মদিন

থুরথুরে সন্ধ্যা হেঁটে যায়
যার কোষে—কসাইয়ের ছুরি আর একটুকরো কাঠের
মধ্যে সময় শুধু সে বোঝে—; ক্ষুধার্ত মা আমার
কুলা হাতে রাত্রি ঝেড়েছিলেন, চিটাধান—অন্ধকার; অতঃপর
আমার জন্মদিন বেঁধে রাখি অদ্ভুত তারকাটায়...
                        কালিঘাটের পটচিত্রের ভিতর।


রূপচাদা ও স্বপ্নসাঁতার

রূপচাদা মাছের সাঁতার থমকে আছে খাবার টেবিলে, এতসবের পরও পাশের বাড়ির পরিচিত একটি গাছের আত্মহত্যার খবর বেরিয়েছে লোকাল কাগজে, কোনো এক বসন্তের অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত পূর্ণিমায় গড়াইয়ের বুকে খণ্ড-খণ্ড ভাসে সে—মৃতবুক সাঁতার সাঁতরায়, সেও শুনে গিয়েছে কোনো এক কালে বসন্ত নেমেছিল লতাচূড়ার পাতায়, —আমরাও শুনেছি বুড়িমা মৃত্যুর কয়েকদিন পর; এখন সে-সব মৃত্যুরা এসে সারারাত সারেঙ্গী সুরে বোবা শব্দ করে, বসন্ত আসে না, বসন্ত শব্দটিও হারিয়েছে অবশেষে, মেদভরা মস্তিষ্ক সর্বত্র, আদি লজ্জায় কুমারী এক ক্ষত বয়ে গেছে চাঁদের গভীরে, শুধু দু'একজন জানে ও-সব, সুন্দর শব্দটি উঠে গেছে, তাতে কার কী যায় আসে? আমরা কতিপয় রূপচাদা শুকনো সমুদ্রে এখনো সাঁতরাই স্বপ্ন বুনি—স্বপ্ন খাই! হয়তো কেউ গৃহপালিত বনশাই হবো কোনো একদিন, কিংবা তাদের খাবার টেবিলে থমকে যাবে আমাদের কারো-কারো স্বপ্নসাঁতার


কে পড়ে কবিতা : পাগলের কলা

গন্তব্য ঝিঁঝিপুর—পৃথিবীতে মৃত দুপুর, প্রেমিকা মরে গেছে
মৃত-মুখ তার, সেও জানত না শবদেহ কার
তারপরও শরীর আগলায় অলংকারে; অন্ধকার করে না
দূর-দূর, আলোরা প্রতারক—নির্ণিমেষ অবিশ্বাস, এখানে দাসেরা
থাকে, বুয়াদের বাড়ি—এই ঝুপড়ি-কামকরা কাঁচা শাড়ি, অপঘাতে
মারা গেছে আইবুড়ো মেয়ে, মাঠে মার্কিনি কাক—আত্মহনন-খুন—
ফুরুৎ পাখি ধরার ছোট্টমেয়ে সিঁদুর পড়েছিল শখে
গোপনে, সকালের কাগজে ছাপা হয় সে, খাম আসে
খোলা খাম—চিঠি নাই, গন্ধ হাওয়ায়—; এই মাঠ এই
দুর্গ—এই পুরাকীর্তির যোনিপ্রদেশে আঘাত করে যারা কিশোরীর
বাচ্চা প্রসব করেছে, শিখেছে চোখ বুজে মানুষ শিকার

এসব দেখে-দেখে কে পড়ে কবিতা যতসব পাগলের কলা
খাতা পোড়ো—মুতে দাও আপনার খাতায়—দেখবে
অক্ষরগুলো জ্বলে উঠছে এক একটি
                              গোরের লিপিকায়।


সমুদ্র খালি পায়ে চলে আসে অন্দরে

তাঁতিবউ শাড়ির পাট খুলেছে তখন
অর্ধেক ভিজেছে জলে
দেখেছি কিংবা দেখিনি, অসম্ভব কৌতূহলে।

ও পাড়ার তাঁতিরা স্বপ্নবিমুখ
প্রজনন মৌসুমে মুমূর্ষু, আশ্রম খোঁজে;
এ পাড়ার কৃষাণীরা দুঃখের আফিঙ কণ্ঠে
ছায়াপর্ব-ছায়ারাত ভালবেসে নিষিদ্ধ সুখের
বৃত্ত ভাঙে, মধ্যবিত্ত মন, জানে না কিছুই
শুধু-শুধু ঈর্ষা আর পলায়ন।
আমি দেখি বিবর্ণ সাদা হাঁস উজান সাঁতরায়,
আর সমুদ্র খালিপায়ে চলে আসে
তাদের অন্দরে, চারদিক নোনাজল—
             হাঁসের ঠোঁটে সময়ের ছায়া, অথচ
             পায়ে পায়ে আলতারাঙানো—
                     বিজয়া-বিজয়া।


মহুয়ার ঠোঁট

আট বেহারার পালকী
উঠে গেছে সেই কবে, এখন ওসবে
মেঘেদের বিয়ে হবে, মৃৎ-মূর্তিতে গড়া
যত আদি মুখ, আনন্দ ছিল সেথায়
বুক ভেজা গান, নেশায় বুঁদ বুঁদ।
ধর্ম, নীল চোখ—ফিরিঙ্গি-আংরেজ
আজিকার ধূর্ত শাসক
সব ঠিক-ঠাক একই, একই ঘরানার অভিভাবক!

এখনো মহুয়ার ঠোঁট গলে ওঠে সাদা চাঁদ
সময় পাল্টায়, পাল্টায় খাদ
চারিদিকে হাতিধরা কলাপাতা-ফাঁদ।


নালন্দা-মেয়ের পুরাণ

অবশেষে মেয়েটি দাঁড়ায় নালন্দার ঢেউয়ের ওপর

নালন্দানদী দূর-বিশ্বে ভাসে
নিম্নতরঙ্গে ভেসে ভেসে সাঁতরায়
                      মহাকাশে...

এ কী বিভ্রম দেখি?
মেয়েটি নালন্দা থেকে
নীলাচলে আঁচল খুলে
নিজেই নদী হয়ে ঢেউ তোলে...

কখনো বা নাগরিক পথ ভুলে, লুকায়
ফুলকপি ক্ষেতের আড়ালে।
দৃশ্যহীন গ্রীবা চারিদিকে তার
পাকাধানরঙ স্তন
           রূপ-বনে শরীরী আষাঢ়!
হেমন্তের আবডালে শীতের হাওয়া ছিল না
           ছিল না অমরার বাড়ি
           দেবী-কন্যা
                     ধরার বাহির।
           অমৃত-প্রবাহে বহে চুমুর আধার
           মেয়েটি উদ্ভিদ হয়ে
           বেঁচে আছে বুকের ভিতর।