প্রিয় দশ

সমুদ্রে পানশালা

সমুদ্রে যাও বালির কাছে জলের কাছে
বালির নিচে আছে সাত রাজার ধন গুপ্ত মানিক
চাকচিক্যময় রুপালি জলের করাতে
জলের ত্রাসে ছুটে পালায় জলহাঙর
দ্বিধার লবণ, সমুদ্রের নৈতিকতা।
রূপচাঁদা মাছ, মদ, সমুদ্র ঝিনুকের মুখে
বালির রসায়ন, ঝাউ বীথি বিবসনা
চাঁদ সঙ্গী, চাঁদ কলঙ্ক বলে কথা নেই কোনো,
প্রতি সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের জন্মের পর।

সমুদ্রের বালি থেকে জল থেকে ফিরে এসে দাঁড়ায়
হোটেল লবিতে বসো তুমি নৈতিক সূর্যোদয়।


সমুদ্রের আহ্বান

সে তাকিয়েছিল দীর্ঘ, পলকহীন দূর থেকে
শান্ত দিঘি নয়, চোখে ছিল সমুদ্র।
সমুদ্র খেলে সর্বনাশের প্রথম চাল
রৌদ্রতাপে দেয় পাখির ডানায় ছায়া স্বস্তি
বহন করে গোপন রোগ, সিফিলিসের উপলক্ষ্য
মাছের আঁশটে গন্ধ, ঘামে লবণের স্বাদ
বন্দর থেকে বন্দরে ভেঁপুর হর্ষ নিনাদ।

সে তাকিয়েছিল দীর্ঘ, পলকহীন দূর থেকে
ছড়িয়ে পড়ে সংক্রামক হাসির প্ররোচনা
কোলাহলের আড়ালে অন্তর্গত ঝরনা ক্ষরণ
দ্রুত সরে যায় পায়ের নিচে বালুর তট
ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বলে হয় আপ্লুত
আবারও সংক্রামিত হতে অগোচর আহ্বানে।


সমুদ্র

সমুদ্র অবগাহনে যেতে চাও
ডুবে যাও চোখের গভীরে
লবণ জল, পাহাড়সম ঢেউ
বাঘের হুংকার, হু হু বাতাস
হাঙর ছোবল সব পাবে।

একটি তিমির ভিতর ঢুকে গেলে
দুঃখের শবদাহ হয় জলের মন্থনে...
অন্তিমের শয্যা আচ্ছাদিত হয়
ভেসে আসে বলে গন্ধমের ঘ্রাণ।

সমুদ্র অবগাহনে যেতে চাও
তার চোখের রক্ত শিরায় দাগ রেখে যাও।


জেল ও পলায়নপর মানুষ

নিশুতি রাতে নিমপাখির ভয়ার্ত কণ্ঠ চুরি করে
কেউ একজন অনুচ্চ স্বরে নাম ধরে ডাকে।
সেই ধ্বনি আধো সাহসের ভিতর তলিয়ে যাবে বলে
শীতরাতে শরীর ঘেমে আর্দ্র বেদনায় কেঁপে ওঠে।
সতর্ক ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে বনাঞ্চলে, ক্ষেতের ভেতর
কালভার্টের নোংরা নালায়, চামড়ায় কাঁটার আঁচড়
যেন গোপন গেরিলার মতো কোনো সংকেত বার্তা
বন্ধুর হাতে পৌঁছে দেবে বিমূর্ত নকশার স্মৃতি।

আজও সদাশয় মানুষ রাতে বন্ধ দরজার কড়া নেড়ে
পুলিশ ও জেলের দুঃসহ স্মৃতির কথা ভেবে
কেঁপে ওঠে—নাম ধরে ডাকে সে অনুচ্চ স্বরে।


দেশভাগ

তিব্বতের মানস সরোবর থেকে—কাগজের দুই দেশ এত নদী জল কীভাবে বহন করে? কাগজ জলদ্রবণে কীভাবে ধারণ করে রক্তের নদী স্রোত, চোখের পলিকণা? যখন মৃত্যু আতঙ্ক চাপা ভয়, ভূগোল নদী, কাঁটাতার সীমান্তরক্ষীর বাইনোকুলার ফোকাস এড়িয়ে মৃত মানুষের হাড়গোড় কিংবা পুড়ে যাওয়া অস্থির ছাই নদীর স্রোতে মিশে গেলে পাখি তার ঠোঁটে আজও বহন করে জন্মান্তরের হাহাকার। কেন পাখি তৃষ্ণার্ত মানুষের অনুকরণে জলপানের ছলে, নদী প্রবাহ ভাগ করার অভিপ্রায়ে পোড়া বাস্তুভিটার কথা মনে করে উড়ে যায় আজও সীমান্তরক্ষীর চোখ আড়াল করে? দুই পাড়েই পড়ে আছে বিষ্ঠার দাগ৷ ছোড়া, কাটারি শিকারির গুলতি, গোপন আততায়ীর হাতে কতবার মৃত্যু হলে, এই স্মৃতি সে ভুলে যাবে।


কুঠার ও কাঠুরিয়ার গল্প

কুঠার মানে উৎকর্ণ ভয়। গাছের আদল—বাকল, হাড় মাংস নয়, কুঠার কাটে বহুদূর থেকে হেঁটে আসা ক্লান্ত পথিকের পথের ছায়া—ভবঘুরের আশ্রয় মায়া, খোঁপায় ফুলের দৃশ্যকাম, বৃষ্টির আঁতুড়ঘর, মীনের বিড়ালপ্রাণ, ক্ষুধার্তের সঞ্জীবনী সুধা। পাখির প্রণয় সংসার ভেঙে গেলে তার বিরহ বিলাপে বিমোহিত হয় যে জনপদ, তা কুঠার মালিকের অগম্যা—আর বৃষ্টি কণিকা নিঃশেষ হয় বলে এক কাঠুরিয়া ঘুমঘোরে দেখে সে শুয়ে আছে জলশূন্য ভিনগ্রহে, জলমগ্ন মাটির ঘর। তার সন্তান মায়ের স্তন থেকে দুগ্ধশস্য নয়, জলসংশ্লেষণের জল নয় আকণ্ঠ পান করে সমুদ্র নুন, খাবার পাত্রে পাথর কণা।


ব্রিজ

সাপগ্রস্ত সম্পর্কে বহুদিন রাস্তাগুলি বিরহ কাতর নদী ও খালের সাঁকো থেকে কতবার যে রচিত হয় সংশয়তাড়িত জীবনগাঁথা, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পিতামহের স্মৃতি, ছড়িয়ে পড়া লোকালয়ের কীর্তি, বন্ধুত্বের আভাস দিয়ে থমকে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা। কিংবা সত্যি একদিন লোকালয়ের কীর্তি ছড়িয়ে পড়লে জলাশয়ের ঢেউগুলি দু-কূলের অভিঘাতে তৈরি হয় সম্পর্কগাথা, সন্দেহগ্রস্ত জনপদের পরম্পরা অভিভূত হওয়ার দিন আজ, ব্রিজে-ব্রিজে জোড়া লাগে দুই তীরের রাস্তা, স্বার্থ, ক্রোধ, প্রতিহিংসায় নিহত প্রতিদিন জলের উপর খেলারত এক জোড়া মিথুন হাঁস। ব্রিজ, তবু দূরে সরে মনের ভিতর দানা বাঁধা জনপদ।


জলদস্যু

জলদস্যু বলতেই জন্ম নেয় অনেকগুলো কল্পত্রাস
তোমাকে নিয়ে যাবে দূর দ্বীপে
কম্পন ঝড় জেগে ওঠে যদি—হাওয়া অভিলাষ
পাঠায় সংকেত বার্তা নিষিদ্ধ অন্তরীপে।

মশালের আলোয় নেচে ওঠে নদীর রজত রেখা
জলে কুমির ও ডোরাকাটা বাঘ এক ডাঙায়
মুখোশের আড়ালেও হলো মুখোমুখি দেখা
অপহৃত হবে—এই বুঝি ছিল গোপন অভিপ্রায়।

ঝড়ের পড়ে মাস্তুলের ধ্বংস চিহ্ন
জলে উদয় হয় ভোর ও অপরাহ্ণ
রক্তমাংসের ঘ্রাণ যদি পায় বাঘ
শিকার যে, জন্ম নেয় তারও কিছু অনুরাগ।

এর নাম তুমি কী দিবে
বর্ষা ফলকে লেগে থাকা নরমুণ্ডুর দাগ—রক্তভাষা
যতনে রেখে কাঁকড়া আহতকে দিলে
দূর্বাঘাস ও গাঁদাফুলের আয়ুর্বেদ আশা।

এই হলো ধর্ম ও সংসারের চক্রব্যুহ—আদিম ইতিহাস
সমুদ্র সঞ্চারিত হয়ে সম্পর্কে ঢুকে যায় সম্পর্ক নাশ।


নদী সংকীর্তন

ঘুমে ও জাগরণে নিহত নদীর লাশ
আমাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে
নির্জন একাকী হিজল বনের নিচে
পথ আটকে দাঁড়াবে মধ্য দুপুরে
সেদিন খুব বেশি দূরে নয়।

নদী তীর, ধূধূ বালুচরের আদিগন্ত নেশা
স্রোতহীন প্রবাহের উপসর্গ,
থেমে যদি যায় জীবনের বাঁক
নদীগ্রস্ত রোগের কথা শোনা যাবে
                    মানুষের মুখে মুখে।

জল ও স্রোতের বেদনা ভুলে গিয়ে
না, নদীগুলো কখনো অপঘাতে নিহত হবে না।
তারা বেঁচে থাকবে জয়নুলের আর্ট গ্যালারিতে
কোনো দৃক্ গ্যালারির আমানুলের ফটোফ্রেমে।


বিপরীতমুখী

কতটা বিপরীতমুখী এ যাত্রা
পাল ছেঁড়া নৌকায় আমি এক নিঃসঙ্গ নাবিক
বড়শিতে গেঁথে তুলি সন্ধ্যার লাল আভা৷

এমনই জোয়ার ভাটার কাল
দু-হাতে কুড়ায় সে সমুদ্র ঝিনুক
দৃশ্য মনোহর আমি এক ফল মাকাল।

চিরকাল নদীর উজানে দাড় টেনে
যেতে চাই দুর গন্তব্যে...
এমনই অদৃষ্ট, ঘর ছেড়ে সমুদ্র বেনে।

কাকে বলি রাতের নির্জনে মনের কথা
কার হাতে শোভা পায় পুষ্প গাঁথা।

আর ঐ দিকে
একজন সন্ধ্যাভাষা নির্মাণ শেষে
অপেক্ষা করতে করতে
বালিশে নয়, একসময় হাতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।