লাতিন আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ মারিও ভার্গাস ইয়োসা। জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৮ মার্চ, পেরুর আরেকিপা শহরে। ২০১০ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৩ এপ্রিল, ২০২৫ সালে ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
প্যারিস রিভিউ-এর "The Art of Fiction No. 120" শিরোনামের সাক্ষাৎকারে মারিও ভার্গাস ইয়োসা তার সাহিত্যচর্চা, লেখালেখির প্রক্রিয়া, রাজনীতি এবং ব্যক্তিজীবন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সুসান্না হানওয়েল এবং রিকার্দো অগুস্তো সেত্তি। প্রকাশিত হয় পত্রিকার ১১৬তম সংখ্যায় (Fall 1991)।
এই সাক্ষাৎকারে মারিও ভার্গাস ইয়োসা তার অফিসে সকালের সময়টুকু লেখালেখির জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলেন। সপ্তাহের ৭ দিনই তিনি কঠোরভাবে তা পালন করেন। তবে ১৯৮৮ সালের শরতে তিনি এই রুটিন ভেঙে ‘লিবেরতাদ’ (Libertad) পার্টির হয়ে পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পেরুর রাজনীতি নিয়ে ভার্গাস ইয়োসা দীর্ঘদিন ধরে স্পষ্টভাবে মত প্রকাশ করে আসছেন এবং তার বেশ কিছু উপন্যাসেও পেরুর রাজনৈতিক বিষয় উঠে এসেছে। তবুও সাম্প্রতিক নির্বাচন পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক পদে প্রার্থী হওয়ার আহ্বান বারবার প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন। প্রচারণার সময় তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনী রাজনীতির আবেগঘন ফাঁপা আওয়াজের সঙ্গে তার মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়।
বহু-দলীয় নির্বাচনের পর ইয়োসা ১৯৯০ সালের ১০ জুন দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে আলবার্তো ফুজিমোরির কাছে পরাজিত হন।
মারিও ভার্গাস ইয়োসা পেরুর দক্ষিণাঞ্চলের ছোট শহর আরেকুইপার (Arequipa)-এ ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকালেই তার বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয় এবং তিনি তার মায়ের সঙ্গে মায়ের দাদাবাড়ি বলিভিয়ার কোচাবাম্বায় চলে যান। ১৯৪৫ সালে ইয়োসা পেরুতে ফিরে আসেন এবং লিওনসিও প্রাদো সামরিক একাডেমিতে পড়াশোনা করেন, এরপর লিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়েন। উনিশ বছর বয়সে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারচেয়ে চৌদ্দ বছরের বড় খালার সঙ্গে। এই বিয়ে তার উপন্যাস Aunt Julia and the Scriptwriter (১৯৮২)-এর বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। লিমাতে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি স্বেচ্ছানির্বাসনে সতেরো বছর কাটান, এই সময়ে তিনি সাংবাদিকতা ও প্রভাষকের কাজ করেন। এই নির্বাসনকালেই তিনি উপন্যাস লেখা শুরু করেন। সামরিক একাডেমির অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা তার প্রথম উপন্যাস The Time of the Hero (১৯৬৩) সালে স্পেনে প্রকাশিত হয়। তার অন্যান্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে আছে The Green House (১৯৬৩), Conversation in the Cathedral (১৯৬৯), এবং The War of the End of the World (১৯৮১)।
মারিও ভার্গাস ইয়োসা একাধারে নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং পেরুভিয়ান টেলিভিশনে একটি সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠানও পরিচালনা করেছেন। তিনি বহু আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত PEN-এর সভাপতি ছিলেন। তিন সন্তানের পিতা ইয়োসা দ্বিতীয় স্ত্রী প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে লিমায় প্যাসিফিক মহাসাগর-উপকূলবর্তী একটি অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করেন।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আপনি খ্যাতিমান লেখক এবং আপনার পাঠকরা জানেন আপনি কী লেখেন। আমাদের বলবেন কি আপনি কী পড়েন?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: গত কয়েক বছর ধরে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা ঘটেছে। লক্ষ্য করে দেখেছি, আমি সমসাময়িক লেখকদের তুলনায় অতীতের লেখকদেরই বেশি পড়ছি। এখন আমি বিশ শতকের চেয়ে উনিশ শতকের লেখা অনেক বেশি পড়ি। এই দিনগুলোতে আমি সাহিত্যিক কাজের চেয়ে প্রবন্ধ ও ইতিহাস বেশি পড়ি। কেন এই ধরনের পাঠ বেছে নিই, সেটা নিয়ে খুব ভাবিনি...মাঝে মাঝে পেশাগত কারণেও পড়তে হয়। আমার সাহিত্যিক প্রকল্পগুলো অনেকটা উনিশ শতককেন্দ্রিক—যেমন, ভিক্টর হুগোর Les Misérables নিয়ে একটি প্রবন্ধ, অথবা ফ্লোরা ত্রিস্তান নামের এক ফরাসি-পেরুভিয়ান সমাজসংস্কারক ও 'প্রাক-নারীবাদী' ব্যক্তির জীবনের ওপর ভিত্তি করে একটি উপন্যাস। আবার পনেরো বা আঠারো বছর বয়সে মনে হয় সময় অফুরন্ত, কিন্তু পঞ্চাশ পেরুলেই বোঝা যায়, সময় সীমিত এবং পড়ার ক্ষেত্রে বাছাই করে নিতে হয়। সম্ভবত এ কারণেই আমি এখন সমসাময়িক লেখকদের কম পড়ি।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: তবুও আপনি যে-সব সমসাময়িক লেখককে পড়েন, তাদের মধ্যে আপনি কাকে বিশেষভাবে প্রশংসা করেন?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: যখন তরুণ ছিলাম, সার্ত্রেকে খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। আমেরিকান লেখকদের, বিশেষ করে ‘Lost Generation'—ফকনার, হেমিংওয়ে, ফিটজেরাল্ড, ডস প্যাসোস—ভেতর ফকনারকে সবচেয়ে বেশি পড়েছি। তরুণ বয়সে যাদের পড়েছিলাম, তাদের মধ্যে ফকনারই আজও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। হেমিংওয়েকে আবার পড়লে মাঝেমধ্যে হতাশ হই, কিন্তু ফকনারের ক্ষেত্রে তা হয়নি। সার্ত্রের রচনাগুলো আজ আর পড়তে চাই না। তার কথাসাহিত্য এখন পুরোনো মনে হয়, মূল্য হারিয়েছে। তার প্রবন্ধগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না, তবে ব্যতিক্রম—‘Saint Genet: Comedian or Martyr’ এখনো পছন্দ করি। কিন্তু এই লেখাগুলোতে অনেক বিরোধ, অস্পষ্টতা, ভুলভাল ও এলোমেলো ভাবনা রয়েছে, যেটা ফকনারের লেখায় কখনো পাইনি।
ফকনারই প্রথম লেখক যাকে কলম ও খাতা হাতে নিয়ে পড়তাম, কারণ তার কৌশল আমাকে অভিভূত করত। তার সময় ও স্থান ব্যবস্থাপনা, বর্ণনার ভঙ্গি, একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প বলার কৌশল—সবই মুগ্ধ করেছে। আমি মনে করি, একজন লাতিন আমেরিকান হিসেবে তার এই কৌশলগুলো আমাদের অঞ্চলের বর্ণনার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
পরে আমি উনিশ শতকের লেখকদের গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছি: ফ্লবেয়ার, বালজাক, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, স্তাঁদাল, হথর্ন, ডিকেন্স, মেলভিল। এখনো আমি উনিশ শতকের সাহিত্য পাঠে মগ্ন।
লাতিন আমেরিকান সাহিত্য নিয়ে বলতে গেলে, আশ্চর্যজনকভাবে, আমি ইউরোপে না যাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী ছিলাম না। লন্ডনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় লাতিন আমেরিকান সাহিত্য পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। তখনই বুঝতে শুরু করি এই সাহিত্যধারার রূপ। তখন থেকেই বোর্হেস, কার্পেন্তিয়ের, কোর্তাসার, গিমারায়েস রোসা, লেসামা লিমা প্রমুখকে পড়তে শুরু করি—গার্সিয়া মার্কেসকে পরে আবিষ্কার করি এবং তার ওপর একটি বই লিখি 'García Márquez: Historia de un Deicidio' নামে।
আমি উনিশ শতকের লাতিন আমেরিকান সাহিত্যও পড়তে শুরু করি, যেটা পড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করি আমাদের অনেক আকর্ষণীয় লেখক রয়েছেন—উপন্যাসিকরা হয়ত কিছুটা কম, তবে প্রাবন্ধিক আর কবিরা বেশ উজ্জ্বল। উদাহরণস্বরূপ, সর্মিয়েন্তো—তিনি কখনো উপন্যাস লেখেননি, কিন্তু তার 'Facundo' আমার মতে এক অনন্যসাধারণ রচনা।
তবে যদি আমাকে একজন লেখকের নাম বলতেই হয়, আমি বলব—বোর্হেস। কারণ তিনি সম্পূর্ণ মৌলিক এক জগৎ তৈরি করেছেন। শুধু মৌলিকতা নয়, তার কল্পনা ও জ্ঞান অনন্য। আর তার ভাষা—স্প্যানিশ ভাষা যেখানে অতিরিক্ত বাগ্মিতার দিকে ঝোঁকে, সেখানে তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত—সংক্ষিপ্ত, সুনির্দিষ্ট ও যথাযথ। তার প্রতিটি শব্দের জন্য যেন একটি করে ভাবনা রয়েছে। তিনি আমাদের সময়ের এক মহান লেখক।
সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: বোর্হেসের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: তাকে প্রথম দেখি ষাটের দশকের গোড়ার দিকে প্যারিসে, সেমিনারে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। পরে আমি তাকে ফরাসি রেডিও-টেলিভিশনের জন্য সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আজও সেই মুহূর্তটি আবেগের সঙ্গে মনে পড়ে।
তারপর বিভিন্ন দেশে আমরা একাধিকবার দেখা করেছি, এমনকি লিমাতেও, যেখানে তার সম্মানে একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছিলাম। শেষে তিনি আমাকে টয়লেটে নিয়ে যেতে বলেন। মূত্রত্যাগের সময় হঠাৎ করে বলেন, ‘ক্যাথলিকরা কি সত্যিই গম্ভীর?’ তারপর নিজেই বলেন, ‘সম্ভবত না।’
শেষবার তাকে দেখি বুয়েনস আইরেসে তার বাড়িতে, যেখানে আমি আমার টিভি শো-এর জন্য তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, কিছু প্রশ্নে তাকে বিরক্ত করেছি। বিশেষ করে সাক্ষাৎকারের শেষে তার বাড়ি দেখে মন্তব্য করেছিলাম—‘এই বাড়ি তো খুবই সাধারণ, দেয়ালের পলেস্তারা উঠেছে, ছাদ থেকে জলের ফোঁটা পড়ে।’ এই কথায় তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন বলে পরে জানতে পারি। অক্টাভিও পাজ আমাকে বলেন, এই মন্তব্য তাকে বেশ আঘাত করেছিল।
তবে সবসময় তার প্রশংসা করেছি। সম্ভবত তিনি কখনোই আমার বই পড়েননি। তিনি নিজেই বলতেন, চল্লিশ বছর বয়সের পর আর কোনো জীবিত লেখকের বই পড়েননি—শুধু পুরোনো বই পড়ে চলেছেন।
তবুও, তাকে খুব শ্রদ্ধা করি। অবশ্য তিনি একমাত্র নন। পাবলো নেরুদাও একজন অসাধারণ কবি। আর অক্টাভিও পাজ—তাকে তো শুধু কবি নয়, রাজনীতি ও শিল্প-সাহিত্য নিয়ে একজন বিশ্লেষণী প্রাবন্ধিক বলে মানি। তার কৌতূহল ছিল সর্বজনীন। এখনো তাকে আনন্দ নিয়ে পড়ি। তার রাজনৈতিক ভাবনাও আমার মতোই।
সাক্ষাৎকারগ্রহিতা: আপনি আপনার পছন্দের লেখকদের মধ্যে নেরুদার কথা বলেছেন। আপনি তো তার বন্ধু ছিলেন। উনি কেমন ছিলেন?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: নেরুদা জীবনকে দারুণভাবে ভালোবাসতেন। তিনি সব কিছু—চিত্রকলা, শিল্পকর্ম, বই, দুর্লভ সংস্করণ, খাওয়া-দাওয়া—সবকিছুর জন্য পাগল ছিলেন। তার জন্য খাওয়া-দাওয়া যেন এক ধরনের রহস্যময় অভিজ্ঞতা। তিনি ছিলেন খুবই আকর্ষণীয় মানুষ, প্রাণে ভরা—যদি তার স্তালিনের প্রশংসায় লেখা কবিতাগুলো ভুলে যান—অবশ্যই তিনি একরকম সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশে বাস করতেন, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই ছিল তার উদ্দাম আনন্দে ভরা। আমি ভাগ্যবান, একবার ইসলা নেগ্রাতে তার সঙ্গে এক সপ্তাহ কাটাতে পেরেছিলাম। এক কথায় তা ছিল অসাধারণ! তার চারপাশে এক ধরনের সামাজিকতা কাজ করত: রান্নাবান্না, অতিথিদের সেবা করা—সবসময়ই লোকজন থাকত। যা খুবই উপভোগ্য ও অত্যন্ত জীবন্ত পরিবেশ; যার মধ্যে কোনো ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ভাব-গাম্ভীর্য ছিল না।
নেরুদা ছিলেন বোর্হেসের ঠিক বিপরীত—বোর্হেস না মদ্যপান করেন, না ধূমপান, না খানাদানায় উৎসাহী, এমনকি মনে হতো প্রেম-ভালোবাসাও করেননি; তার কাছে এসব কিছু গৌণ, আর করলেও তা কেবল ভদ্রতার খাতিরেই করেছেন। কারণ বোর্হেসের কাছে জীবন মানে ভাবনা, পড়াশোনা, প্রতিফলন, আর সৃষ্টিই—শুধু বৌদ্ধিক জীবন। অন্যদিকে, নেরুদা সেই ধারা থেকে এসেছেন—জর্জে আমাদো বা রাফায়েল আলবার্তির মতো কবিরা—যারা বিশ্বাস করেন সাহিত্য তৈরি হয় জীবনের ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতা থেকে।
এখনও মনে করতে পারি লন্ডনে নেরুদার জন্মদিন উদ্যাপনের দিনটার কথা। তিনি চেয়েছিলেন পার্টিটা টেমস নদীর ওপর একটি নৌকায় হোক। সৌভাগ্যবশত তার এক ভক্ত, ইংরেজ কবি আলাস্তার রিড, টেমসের ওপর একটি নৌকাতেই থাকতেন, তাই আমরা ইচ্ছাপূরণের পার্টি আয়োজন করতে পারলাম। সেই পার্টিতে নেরুদা বললেন, উনি নিজেই ককটেল বানাবেন। যা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দামি পানীয়—ডম পেরিনিয়ঁর সঙ্গে ফলের রস, আরও কত কী! ফলাফল অবশ্যই দারুণ ছিল, মাত্র এক গ্লাসেই মাতাল হওয়া যেত, আমরা সবাই একেবারে মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম।
এখনও মনে করি, তখনই তিনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, যেটা সময়ের সাথে সাথে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। সেই সময় একটা প্রবন্ধ আমাকে খুবই আহত করেছিল, অপমান করেছিল এবং মিথ্যে কথা লিখেছিল—ওটা নেরুদাকে দেখালাম। পার্টির মধ্যেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন: ‘তুমি এখন জনপ্রিয় হচ্ছো। তুমি জানো কী অপেক্ষা করছে তোমার জন্য: যত বেশি বিখ্যাত হবে, তত বেশি এই ধরনের আক্রমণের মুখোমুখি হতে হবে। এক প্রশংসার পেছনে থাকবে দুইটা বা তিনটা অপমান। আমার নিজের কাছে একটা বুকভর্তি অপমান জমে আছে—যত রকমের অপবাদ একজন মানুষের বিরুদ্ধে দেয়া যায়, আমি পেয়েছি—চোর, বিকৃতমনস্ক, বিশ্বাসঘাতক, গুন্ডা, স্ত্রীকে ঠকানো স্বামী...সবই!’
নেরুদা ঠিকই বলেছিলেন; তার ভবিষ্যদ্বাণী একদম সত্যি হয়েছে। এখন আমার কাছে শুধু এক বুক নয়, কয়েকটা স্যুটকেস ভর্তি আছে এসব অপমানজনক লেখায়।
সাক্ষাৎকারগ্রহিতা: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সম্পর্কে বলুন।
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: আমরা বন্ধু ছিলাম; বার্সেলোনায় দুই বছর একই রাস্তায় প্রতিবেশী ছিলাম। পরে আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়—ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক কারণেই। তবে মূল বিচ্ছেদ হয়েছিল একান্ত ব্যক্তিগত কারণে, যার সঙ্গে তার রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো সম্পর্ক ছিল না—যেগুলো আমি অবশ্যই সমর্থন করি না। আমার মতে, তার সাহিত্য আর তার রাজনীতি এক মানের নয়। লেখক হিসেবে তার কাজের খুবই প্রশংসা করি। তাকে নিয়ে ছয়শ পৃষ্ঠার বই লিখেছি। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে, এবং তার রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নেই, কারণ সেগুলো আমার চোখে গুরুত্বহীন এবং প্রচারনাধর্মী।
সাক্ষাৎকারগ্রহিতা: মেক্সিকোর একটি সিনেমা হলে আপনাদের মধ্যে কোনো মারামারির ঘটনা ঘটেছিল কি?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: মেক্সিকোতে একটা ঘটনা ঘটেছিল ঠিকই। তবে এটা এমন একটা বিষয় যেটা আমি আলোচনা করতে চাই না; এ নিয়ে অনেক বেশি গুজব ছড়িয়েছে, আমি আর কোনো গুজবের খোরাক দিতে চাই না। যদি কোনোদিন আত্মজীবনী লিখি, তখন হয়ত পুরো সত্যটা বলব।
সাক্ষাৎকারগ্রহিতা: আপনি কি আপনার উপন্যাসের বিষয়বস্তু নিজে বেছে নেন, না সেগুলো আপনাকে বেছে নেয়?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: আমার অভিজ্ঞতা বলে, বিষয়বস্তু লেখককে খুঁজে বের করে। সবসময়ই মনে হয়েছে কিছু গল্প এমনভাবে আমার উপর চেপে বসেছে, যেন আমি তা এড়াতে না পারি—কোনো এক রহস্যময়ভাবে তা আমার কোনো গাঢ় অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত ছিল। যেমন ধরুন, আমি যখন লিওনিকো প্রাদো মিলিটারি স্কুলে পড়তাম, তখনকার সময়টা আমার জন্য খুবই ট্রমাটিক ছিল। সেই অভিজ্ঞতা যেন আমার শৈশবের শেষবিন্দু চিহ্নিত করেছিল—আমার দেশের সহিংস রূপ, বিভক্ত সমাজ, সংস্কৃতি, জাতিগত বৈষম্য—সবকিছু আমার সামনে উদঘাটিত হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে লিখতে বাধ্য করেছিল।
এখনও পর্যন্ত আমার সব লেখাই এমনভাবে এসেছে। কখনোই মনে হয়নি আমি খুব হিসেব করে, বুদ্ধি খাটিয়ে, কোনো গল্প লিখতে বসেছি। বরং কোনো ঘটনা, মানুষ, স্বপ্ন বা পড়াশোনা কোনো কিছু হঠাৎ এসে চেপে বসে, আর আমাকে টানতে থাকে। এই কারণেই আমি সাহিত্যে অযৌক্তিকতার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলি। এই অযৌক্তিকতার ছোঁয়া পাঠকের কাছেও পৌঁছাতে হবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমি চাই আমার উপন্যাসগুলো পাঠক এমনভাবে পড়ুক, যেভাবে আমি [অন্যদের] উপন্যাস পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, যে-সব গল্প আমাকে একেবারে ভাবনার বাইরে নিয়ে যায়, সমালোচনামূলক ক্ষমতা নিঃশেষ করে দেয়—সেইরকম উপন্যাসই আমি লিখতে চাই। আমার মতে, উপন্যাসের কারিগরি অংশটার মূল উদ্দেশ্যই হলো—পাঠক ও গল্পের মধ্যেকার দূরত্ব কমিয়ে ফেলা, এমনকি একেবারে বিলীন করে দেওয়া। এই দিক থেকে আমি নিজেকে ঊনবিংশ শতকের লেখক বলে ভাবি। আমার কাছে উপন্যাস মানেই অ্যাডভেঞ্চার, যেটা পড়তে হবে সেই নির্দিষ্ট মুগ্ধতার অভিজ্ঞতায়।
সাক্ষাৎকারগ্রহিতা: আপনার সাম্প্রতিক উপন্যাসগুলোতে আগের মতো রসিকতা দেখা যায় না। আন্ট জুলিয়া অ্যান্ড দ্য স্ক্রিপ্টরাইটার-এর হাস্যরস কোথায় হারালো? আজকাল কি রসবোধ ধরে রাখা কঠিন?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: কখনোই ভাবি না, আজকে আমি হাস্যরসাত্মক কিছু লিখব, নাকি গম্ভীর কিছু। আমার সাম্প্রতিক লেখাগুলোর বিষয়বস্তু নিজেই রসবোধের জন্য অনুপযুক্ত ছিল। ওয়ার অফ দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, আলেহান্দ্রো মাইতার বাস্তব জীবন, বা আমার নাটকগুলো—এসব এমন বিষয় নিয়ে লেখা যেগুলোকে রসাত্মকভাবে দেখানো কঠিন। আর ইন প্রেইজ অফ দ্য স্টেপমাদার? সেখানে তো অনেক হাস্যরস আছে, তাই না?
এক সময় আমি রসিকতায় অ্যালার্জিক ছিলাম। ভাবতাম, সিরিয়াস সাহিত্য কখনো হাসে না; ভাবতাম আমি যদি সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির গুরুতর বিষয় নিয়ে লিখতে চাই, তাহলে রসিকতা গল্পকে হালকা বানিয়ে ফেলবে। এই কারণে আমি রসিকতা বাদ দিয়েছিলাম, সম্ভবত সার্ত্রের প্রভাবেই—যিনি নিজের লেখায় খুব কমই রসিকতা করতেন। কিন্তু একদিন আমি বুঝলাম, জীবনের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা সাহিত্যে তুলে ধরার জন্য রসিকতা দারুণ কার্যকর হতে পারে। সেটা ঘটেছিল পান্তালেওন অ্যান্ড দ্য স্পেশাল সার্ভিস লেখার সময়। তখন থেকেই রসিকতাকে একধরনের রত্ন হিসেবে বিবেচনা করি—যা জীবনের একটি মৌলিক উপাদান এবং সাহিত্যেরও। ভবিষ্যতে রসিকতা আবার ফিরে আসতে পারে আমার লেখায়—আসলে সেটা তো ইতোমধ্যেই ফিরে এসেছে, যেমন আমার নাটক ক্যাথি অ্যান্ড দ্য হিপোপটামাস।
সাক্ষাৎকারগ্রহিতা: আপনার লেখার অভ্যাস কেমন? কীভাবে কাজ করেন? একটা উপন্যাস কীভাবে শুরু হয়?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: প্রথমেই এটা একধরনের দিবাস্বপ্ন, মানসিকভাবে একটা ভাবনা ঘুরপাক খায়—একটা চরিত্র, একটা পরিস্থিতি। এরপর আমি নোট নিতে শুরু করি, কাহিনির অংশবিশেষের সারাংশ লিখি: কেউ ঢুকছে, কেউ বেরোচ্ছে, এই কাজটা করছে ইত্যাদি। তারপর আমি একটি সামগ্রিক প্লটের খসড়া তৈরি করি—যেটা পরে আমি সম্পূর্ণ বদলে ফেলি, যা আমাকে শুরু করার জন্য সহায়তা করে। এরপর আসল লেখার কাজ শুরু করি, তখন আমি স্টাইল নিয়ে একটুও চিন্তা করি না—একই দৃশ্য বারবার লিখি, এমনকি একেবারে বিপরীত পরিস্থিতিও বানাই...
এই কাঁচা উপাদান আমাকে সাহায্য করে, সান্ত্বনা দেয়। তবে এটাই লেখার সবচেয়ে কঠিন ধাপ। আমি তখন খুব সতর্কভাবে এগোই, সবসময় অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকি। প্রথম খসড়া লেখার সময় দারুণ উদ্বেগ কাজ করে। তবে একবার সেই খসড়া শেষ হয়ে গেলে—যা অনেক সময় নিতে পারে, যেমন ওয়ার অফ দ্য এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড-এর ক্ষেত্রে প্রায় দুই বছর লেগেছিল—সবকিছু বদলে যায়। তখন বুঝতে পারি, গল্পটা আসলে জন্ম নিয়েছে, এই বিশৃঙ্খলার নিচে লুকিয়ে আছে। এটাকে আলাদা করতে হবে, পরিশোধন করতে হবে—আর এই কাজটাই সবচেয়ে আনন্দদায়ক। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে পারি—প্রথম খসড়ার সেই উদ্বেগ আর থাকে না।
আমি মনে করি, লেখার প্রকৃত সৃজনশীল অংশ হলো সম্পাদনা, সংশোধন ও পুনর্লিখন। কখন গল্প শেষ হবে তা আগে থেকে জানি না। কখনো মনে হয়, দু-তিন মাসে শেষ হয়ে যাবে, অথচ সেটা শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যায়। আমার মনে হয়, গল্প তখনই শেষ হয় যখন আমি নিজে ক্লান্ত হয়ে যাই, যখন মনে হয়—আর নিতে পারছি না। তখনই গল্প শেষ হয়।
সাক্ষাৎকারগ্রহিতা: আপনি কি হাতে লেখেন, না টাইপরাইটারে, নাকি দুটোই?
মারিও ভার্গাস ইয়োসা: প্রথমে হাতে লিখি। সবসময় সকালে কাজ করি এবং দিনের প্রথম ভাগে হাতে লিখি। ওই সময়টুকু সবচেয়ে সৃজনশীল সময়। কখনোই দুই ঘণ্টার বেশি হাতে লিখি না—আমার হাত ব্যথা হয়ে যায়। তারপর যা লিখেছি তা টাইপ করতে শুরু করি, এবং সাথে সাথে কিছু পরিবর্তন করি; এটি সম্ভবত প্রথম পুনঃলিখনের পর্যায়। কিন্তু সবসময় কিছু লাইন টাইপ না করে রেখে দিই, যাতে পরের দিন যে শেষ লাইনটা লিখেছিলাম তা দিয়ে আবার শুরু করতে পারি। টাইপরাইটারে শুরু করলে একটা নির্দিষ্ট গতিশীলতা তৈরি হয়—যা ওয়ার্ম-আপ এক্সারসাইজের মতো।