ভালোবাসা দিবস বিশেষ

কেমন জীবনসঙ্গী চায় এখনকার প্রজন্ম?

একসময় পত্রিকায় সারি সারি ‘পাত্র চাই-পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন থাকতো। সেখানে ‘ফর্সা মেয়ের’ চাহিদা কিংবা ‘লম্বা ছেলের’ চাহিদার কথা ঘুরে ফিরে আসতো বারবারই। যদিও পাত্র-পাত্রীর চাইতে বিয়ের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেতো পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মত। তবে এখন দিন বদলেছে। এখনকার তরুণ-তরুণীরা চান নিজেদের পছন্দেই জীবনসঙ্গী বেছে নিতে।

‘সুন্দরী মেয়ে’ কিংবা ‘প্রতিষ্ঠিত ছেলের’ চাহিদা একেবারেই কমে গেছে, এমনটা নয়। তবে এখন শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি প্রাধান্য পাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। মানসিক মিল, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা ও বোঝাপড়ার ব্যাপারে যত্নশীল হওয়ার ব্যাপারে আপস করছেন না এখনকার তরুণ-তরুণীরা। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ও সদ্য লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে চাকরি বা ব্যবসা শুরু করা বর্তমান প্রজন্মের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে তাদের পছন্দ-অপছন্দ জানতে চেয়েছিল বাংলা ট্রিবিউন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন শবনম বসির একা। তিনি বলেন, ‘জীবনসঙ্গী হিসেবে সেই মানুষটাকেই চাই যে আমাকে সম্মান করবে। সম্মান যদি দুজন দুজনের মধ্যে সমান থাকে, বিশ্বাস থাকে, তাহলে সম্পর্কটা সুন্দর হবে। মেয়েদের ক্যারিয়র গড়া একটু কঠিন হয় সংসার জীবনে গেলে, সেই জায়গা থেকে তাকে অবশ্যই সাপোর্টিভ মানসিকতার হতে হবে। এছাড়াও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা জরুরি। কারণ, একটা সম্পর্কে দুই জনকেই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। এতে বোঝাপড়াটা সহজ হয়।’

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য বিবিএ শেষ করেছেন অর্ণব দাশ। তিনি বলেন, ‘জীবনসঙ্গী হিসেবে সেই মানুষটাকে চাই, যার সঙ্গে আমি অনায়াসে আমার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ভাগ করতে পারি। যে মানুষটা আমাকে আগাগোড়া জানবে, আমার ভালো অভ্যাসগুলো জানবে, আমার খারাপ অভ্যাসগুলোও সমানভাবে জানবে, কিন্তু খারাপ অভ্যাসগুলো নিয়ে হীনম্মন্যতায় ফেলবে না আমাকে। যে মানুষটার সঙ্গে আমি চাইলেই অনায়াসে এক কাপ চা সঙ্গে আড্ডা দিতে পারবো। মানুষটা হবে আমার বন্ধুর মতো। যখন মন খারাপ হবে, আমাকে যেমন সান্ত্বনা দেবে, তেমনি অনুপ্রেরণাও দেবে।’

আরমান হাসান পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে এখন একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, ‘জীবনসঙ্গীকে অবশ্যই বুদ্ধিমান হতে হবে, সংসারের সঙ্গে তার ক্যারিয়ারেও সমান মনোযোগী হতে হবে। দুই জন মানুষ গোটা জীবনটা একসঙ্গে কাটানোর জন্য মনে হয় সবচেয়ে জরুরি বোঝাপড়া, তাই তাকে আমাকে বুঝতে হবে। জীবনে যেকোনও পরিস্থিতিতে সে আমার সঙ্গে থাকবে, যেকোনও পরিস্থিতি সে মোকাবিলা করতে পারবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী অন্তরা তালুকদার বলেন, ‘জীবনসঙ্গী হিসেবে এক কথায় একজন ভালো মনের মানুষ চাই। যিনি ধার্মিক, তবে ধর্মান্ধ নয়। সব মিলিয়ে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ হবেন, যেকোনও পরিস্থিতি শক্তভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন, তবে রূঢ় হওয়া চলবে না। চলার পথে নিজেদের মধ্যে কোনও ঝামেলা হলে, তিনি আমাকে বুঝবেন। সেভাবে মিলিয়ে চলার মানসিকতা থাকতে হবে।’

আহনাফ তাহমদি ফাইয়াজ, কাজ করছেন সংবাদকর্মী হিসেবে। তিনি বলেন, ‘প্রথম কথা সে আমাকে বুঝবে। এরপর আমার জীবনসঙ্গীকে অবশ্যই আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সে তার ক্যারিয়ারে সফল হবে, সমানভাবে আমার সঙ্গে ঘরও সামলাবে। আমার ভ্রমণে আগ্রহ অনেক বেশি, ইচ্ছে আছে পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখার। আমার জীবনসঙ্গী সমমানসিকতার হলে আমার ভ্রমণের ইচ্ছে পূরণ সহজ হবে। বই, বিশ্বরাজনীতি, শিল্প নিয়েই অধিকাংশ সময় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হয়। বিয়ের পর হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় হবে না সেভাবে, তাই এমন একজন মানুষ চাই এগুলো প্রাণখুলে যার সঙ্গে আড্ডা দিতে পারবো। সব মিলিয়ে জীবনসঙ্গী আমার প্রিয়বন্ধু হিসেবে সারা জীবন সঙ্গে থাকবে আমার।’ 

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে চাকরি খুঁজছেন বৃষ্টি তাবাসসুম। তিনি জানালেন, পরিবার থেকে প্রবাসী ছেলেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হলেও তিনি চান তার জীবনসঙ্গী এ দেশেই থাকুক। কারণ, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান তিনি। বাবা-মায়ের কাছে থেকেই তাদের দেখাশোনা করতে চান তাই। তার জীবনসঙ্গীকেও ব্যাপারটির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।

স্থপতি হিসেবে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন রীতা ভৌমিক। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স ৩৫ চলছে। সামাজিক আর পারিবারিকভাবে বিয়ের জন্য ভয়ংকর চাপ দেওয়া হয়। তবে পছন্দসই কাউকে না পাওয়া পর্যন্ত আমি বিয়ে করবো না। এটাই আমার সিদ্ধান্ত। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বিনয়ী ও ভালো মনের মানুষ চাই সারা জীবন একসঙ্গে থাকার জন্য। আবার মিলতে হবে মনমানসিকতাও। মোট কথা, যার ব্যাপারে মনে হবে এতদিন তাকেই খুঁজছিলাম, সেই হবে আমার জীবনসঙ্গী।’

কথা হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. সাবিনা শরমীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে চলে। এভাবে চলতে চলতে একে অন্যের প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করে। তারা একজনের ভালো গুণ, মানসিকতা, বোঝাপড়া দেখে সম্পর্কে জড়ায়। পরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য এটা সহজ হলেও অনেক সময় দেখা যায় সিদ্ধান্ত ভুল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে একটা সম্পর্কে জড়ানো বা জীবনসঙ্গী খোঁজার ক্ষেত্রে বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’ 

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শিপ্রা সরকার বলেন, ‘বর্তমান সময়ে মানুষ প্রযুক্তি দ্বারা বেশি প্রভাবিত হচ্ছে। সবকিছু দেখার সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলে সে বৈশ্বিকভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাচ্ছে। সে সারা বিশ্বের সংস্কৃতি দেখছে, সেই জায়গায় নিজেকে ভাবছে। ফলে এই জায়গায় একজন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীনভাবে দেখছে। ফলে তার সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অনেক বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। সামাজিক বিভিন্ন পরিবর্তনের ফলে পরিবারের একটা চাহিদা যেমন এখানে থাকছে, তেমনই সামাজিক, ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা খারাপ লাগাকেও প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। সঙ্গীর প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা, তার সামাজিক অবস্থান, চারিত্রিক গুণাবলি সবকিছু দেখেই নির্বাচন করতে হচ্ছে। যাতে একটা পরিবার গঠনের পর পরবর্তীতে তা ভেঙে না যায়। দীর্ঘদিন পরিবার টিকিয়ে রাখতে এই বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। শুধু নিজের ভালো লাগা নয়, সঙ্গীর সঙ্গে সামাজিকভাবেও নিজের অবস্থানকে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।’ 

মডেল: ফারহান ও সুবাহ 
ছবি: ওয়েডিং ডায়েরি বাংলাদেশ