‘সোয়াপ ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ চালুর কথা ভাবছে সরকার 

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালে কিডনিসহ মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে স্বেচ্ছা শুভাকাঙ্ক্ষী দাতার ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা নিরসনে বিদ্যমান আইন ও বিধি সংশোধন করতে বলেছেন হাইকোর্ট। বিদ্যমান আইনে নিকট আত্মীয় কিংবা আইনানুগ উত্তরাধিকারী ছাড়া অঙ্গদানের বিধান নেই। অবৈধ কিডনি ব্যবসা রোধ এবং স্বেচ্ছা শুভাকাঙ্ক্ষী দাতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতের রায়ে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই আইনে এখন ‘সোয়াপ ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ অন্তর্ভুক্তির কথা ভাবছে মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।  

মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, বিদ্যমান আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে নিকট আত্মীয়ের সংজ্ঞা। আইন অনুযায়ী জীবিত ব্যক্তি নিকট আত্মীয়ের ক্ষেত্রে অঙ্গদান করতে পারেন। আইনে “নিকট আত্মীয়” অর্থ পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও রক সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি, আপন চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো, খালাতো ভাই বা বোন। এক্ষেত্রে আইন সংশোধন করে  ভাতিজা, ভাতিজি ও ভাগ্নে, ভাগ্নি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

অপরদিকে ‘ব্রেইন ডেথ’ রোগীর অঙ্গ নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনানুগ উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নেওয়ার বিধান আছে। আইনানুগ উত্তরাধিকারী হচ্ছেন—স্বামী, স্ত্রী, প্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র ও কন্যা, পিতা, মাতা, প্রাপ্তবয়স্ক ভাই ও বোন এবং রক্ত সম্পর্কের অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক আত্মীয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালের এই আইন সংশোধন করে সেখানে ‘সোয়াপ ট্রান্সপ্ল্যান্ট’-এর বিধান অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আইনে এই বিধানের নাম বলা হবে—‘অসামঞ্জস্য জোড়া বিনিময় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ’। আইনে সংজ্ঞা হিসেবে বলা হবে— ‘অসামঞ্জস্য জোড়া বিনিময় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন’ বা সোয়াপ ট্রান্সপ্ল্যান্ট। এর অর্থ এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে রোগীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন, কিন্তু তার দাতার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মিলছে না, তবে অন্য একজনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে মিলছে। তারা অন্য একজন ‘অসঙ্গত’ দাতা-গ্রহীতা জুটির সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিনিময় করতে পারবেন। এর ফলে উভয় রোগীই একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পেতে পারেন—যা সফল প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।

কোন পদ্ধতিতে এই ‘সোয়াপ ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ হবে, সেই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দাতা-গ্রহীতা জুটি যখন বেমানান হয়, তখন তারা জোড়া বিনিময় কর্মসূচিতে নাম নথিভুক্ত করবেন। চিকিৎসা প্রদানকারী হাসপাতাল বা জাতীয় রেজিস্ট্রি থেকে বেমানান জোড়ার একটি ডাটাবেজ বজায় রাখা হবে—যেখানে অসামঞ্জস্যপূর্ণ জোড়াগুলো মিল খুঁজে বের করবে। এই রেজিস্ট্রি থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ দুটি জোড়া খুঁজে বের করা হবে। অতঃপর ওই জোড়ার মধ্যে দাতা-গ্রহীতার বিনিময় করবে। দাতা-গ্রহীতার সব অস্ত্রোপচার একই দিনে করতে হবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দাতা-গ্রহীতার ক্ষেত্রে একই সময়ে একই হাসপাতালে বিনিময় ও প্রতিস্থাপন করতে হবে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বিদ্যমান আইন সংশোধনে দেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। বৈঠকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. সৈয়দ আলফাসানি, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ইউরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম খুরশিদুল আলম, ইউরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলামসহ স্বাস্থ্য ও আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় বিশেষজ্ঞরা অঙ্গ ট্রান্স প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেন। তারা বলেন, জীবিত ব্যক্তির অঙ্গদানে উদ্বুদ্ধ করতে দাতাকে সম্মাননাসহ সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এছাড়া ক্যাডেভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয়ের অনুমতি পাওয়া বেশ চ্যালেঞ্জ হওয়ায় তাদের সম্মাননা, কিংবা প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সেই বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়।

ফেব্রুয়ারির ওই সভায় অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান জনপ্রিয় হচ্ছে। আমাদের দেশে এর পুরোপুরি সুফল পেতে হলে মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন-বিষয়ক বিদ্যমান আইনটি সংশোধন ও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সোয়াপ ট্রান্সপ্ল্যান্ট চালু করার বিধান ওই আইনে অন্তর্ভুক্ত করে কিডনি প্রতিস্থাপনের পথ আরও সুগম করা এখন সময়ের দাবি।’

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের বিভিন্ন দিক পরিমার্জন, সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সবার মতামত নেওয়া হচ্ছে। আগামী সোমবার (২৮ এপ্রিল) মন্ত্রণালয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরেকটি বৈঠক আছে। সেখানে আরও বিস্তর আলাপ হবে এ নিয়ে। সবার মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে কাজটি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আইন চূড়ান্ত হতে কিছুটা সময় লাগবে।’

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রেয়াটিক এবং লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. বিধান চন্দ্র দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোয়াপ ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ বলতে বোঝায়—ধরুন, আমার একটি কিডনি দরকার। সেই কিডনি আমার আত্মীয়ের কাছ থেকে নিতে হবে। এখন আমার ভাই অথবা বোন দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে রক্তের গ্রুপ কিংবা অন্য প্যারামিটার মিলছে না। তাহলে বিষয়টা হচ্ছে, সে দিতে চাচ্ছে কিন্তু আমি নিতে পারছি না। এরকম একই কারণে আরেকজন রোগীর ক্ষেত্রে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যাচ্ছে না। কিন্তু ওই দাতার সঙ্গে আমার ক্ষেত্রে মিলে যাচ্ছে, তবে তারা আত্মীয় না। কিন্তু এই অঙ্গের আদান- প্রদান হলে দুটি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘সোয়াপ ট্রান্সপ্ল্যান্ট’। এটা করলে ডোনারের যে ব্যাপ্তি, সেটা বাড়ানো যায়।