কোভিডকে ভুলে যাওয়ার সময় কি এসেছে?

কেন করোনা টেস্ট করতে অনীহা

কী যে কষ্ট পেলাম! একদম কোভিডের মতো মনে হলো। বুকে ব্যথা। জ্বর বেশি না উঠলেও ঠান্ডাটাই বেশি। কাশি দিতে গেলে বমি হয়ে যায়। কিছু খেতেই পারি না। সাত দিনে শরীর ভেঙে গেছে। টেস্ট করিয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে বলেন— না, চার দিন পরে ডাক্তারের কাছে গেলাম, অন্যান্য টেস্টের সঙ্গে ডেঙ্গু ও কোভিড টেস্টও দিয়েছিলেন। ডেঙ্গু করিয়েছি। কোভিড করানো হয়নি। খামোখা ঝামেলা, তিনটা টিকা দেওয়া আছে।

জ্বর নিয়ে এই ভোগান্তির কথা জানান— বেসরকারি চাকরিজীবী মাসুদুর রহমান। ২০২০ সালে তার দুই বার করোনা পজিটিভ হয়েছিল। সেই সময়ের ভোগান্তির সঙ্গে এবারের মিল খুঁজে পেয়ে তার প্রশ্ন— আসলেই কি করোনা চলে গেছে? কেবল মাসুদ নন, এরকম নানা ভোগান্তির কথা বলছেন মানুষ। জ্বর, ঠান্ডা, মুখে স্বাদ না থাকা— এসব মিলিয়ে নিচ্ছেন আগের অভিজ্ঞতা থেকে। কিন্তু কেউ আর টেস্ট করাচ্ছেন না।

ফাতেমা নাসরিন নিজে জ্বর থেকে উঠতে না উঠতে পরিবারের সদস্যরা একের পর এক ভুগতে শুরু করেন। তিনি বলেন, আমার কখনও জ্বর এলে এত দীর্ঘ সময় শরীর খারাপ থাকেনি। ১০ দিনেও শরীরে শক্তি ফিরে আসে না। কী বাজে কফ-কাশি নিয়ে কাটাচ্ছি। মুখে কোনও স্বাদ নেই। আমারটা সারতে না সারতে ছেলের জ্বর হলো। আবারও ৮দিনের ধাক্কা। আগেও জ্বর হয়েছে, এরকম কষ্ট হয়নি। চিকিৎসক বলেছিলেন, টেস্ট করাতে কিন্তু করানো হয়নি।

বাংলাদেশে করোনা টেস্ট বা এর নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসছে কিনা, তা নিয়ে কোনও গবেষণা বা তথ্য নেই। পাশের দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে— অন্য রোগ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর রুটিন করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ রিপোর্ট আসছে। মাস কয়েক আগে করোনা ভাইরাসের নতুন উপপ্রজাতি ‘কেপি.২’-র খোঁজ মিলেছে সেখানে। করোনার ওমিক্রন প্রজাতির ওই সাব-ভ্যারিয়েন্ট (কেপি.২)-এর প্রকোপে যুক্তরাষ্ট্রেও আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ওমিক্রনের একটি ভ্যারিয়েন্ট কেপি-২ এর সংক্রমণে ২৮.২ শতাংশ মানুষের কোভিড আক্রান্তের খবর মিলেছে। গত মার্চ মাসে বেশকিছু রোগী চিহ্নিত হয়। প্রতিবেদন বলছে, গত চার বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিডের গ্রীষ্মকালীন তরঙ্গ দেখা গেছে এবং চলতি গ্রীষ্মেও সেটি বাড়তির দিকেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যদিও তা গত মৌসুমের তুলনায় কম গুরুতর বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সান ফ্রান্সিসকোর (ইউসিএসএফ) মেডিসিনের অধ্যাপক এবং সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর পিটার চিন-হং এবিসিকে বলেছেন, ‘গত চার বছরে গ্রীষ্মকালে আমাদের কোভিডের সংক্রমণ বেড়েছে। আমরা এই গ্রীষ্মেও বৃদ্ধির শঙ্কা করছি, তবে এটি সম্ভবত খুব বেশি বাড়বে না।’

তীব্র গরমে জ্বর-সর্দি-কাশির সমস্যা লেগেই রয়েছে। সিম্পটমগুলো করোনার সঙ্গে মিলিয়ে মানুষ সন্দেহ করলেও নানা কারণে টেস্টের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। তবে, করোনা নিয়ে অযথা আতঙ্কিত না হওয়ার কথাই বলছেন চিকিৎসকরা। তাদের কথায়, ‘ওই ভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, তেমনটা তো নয়। তবে সেটি এখন আগের মতো মারাত্মকও নয়।’

পশ্চিম বাংলা থেকে শুরু করে আমেরিকা প্রায়শই নতুন ভ্যারিয়েন্ট এবং সেগুলো বার বার ফিরে আসার তথ্য দিচ্ছে, অথচ আমাদের এখানে করোনার উপকরণ নিয়ে হাসপাতালে গেলেও টেস্ট করানো হচ্ছে না কেন, প্রশ্নে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘জ্বরের নানা প্যাটার্ন রয়েছে। করোনা, ডেঙ্গু, সাধারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও জ্বর হয়। রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পক্ষ থেকে গবেষণা করা দরকার— এখন যে জ্বর সেটি কোন প্যাটার্নের, তা শনাক্তকরণের জন্য। সেটি ঠিকমতো করা হয় না বলেই চিকিৎসকমহলের মধ্যে সংশয় কাজ করে যে, জ্বরগুলো কী ধরনের। উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা না করে পূর্ণাঙ্গ ভাইরোলজিক্যাল পরীক্ষা দরকার। তা না হলে অসম্পূর্ণ বা ভুল ধারণা থেকে যায়।’

এ সময় যাদের জ্বর হচ্ছে তারা এটাকে করোনার মতো কষ্ট বলেই চিহ্নিত করছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো আসছে কিনা, তা জানার চেষ্টা থাকা দরকার বলে মনে করেন কিনা, জানতে চাইলে করোনাভাইরাস মহামারি মোকোবিলায় একটি ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’র সদস্য ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনা এখন স্থায়ীভাবে রেসপিরেটরি ইলনেস ভাইরাসে পরিণত হয়েছে। ফলে অন্যান্য ভাইরাসের মতো সেটিরও প্রকোপ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এটিকে ভুলে যাওয়ার সময় আসেনি। মহামারি চলে গেছে এটা বলার উপায় নেই। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এটা মনিটরিং হওয়া খুব দরকার। কেননা, এখনকার জ্বরে কাশিটা যেমন দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, সেটা স্বাভাবিক না। যে যে উপসর্গগুলোর কথা বলছে রোগীরা, সেটা কেন, এইটা জানা দরকার। আবার শুরু থেকেই ভ্যাকসিনের রোল নিয়েও আলোচনা সমালোচনা আছে। তিন ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও কোভিড হয়েছে, এমন রোগী আছে। তাহলে পরিস্থিতি আসলে কী, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।’