মেডিক্যাল বর্জ্য সবসময়ই জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য অন্যতম হুমকি হয়ে বিবেচিত হয়ে আসছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গত দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মহামারি শুরুর পর থেকে ফেলে দেওয়া সিরিঞ্জ, কোভিড শনাক্তে ব্যবহৃত কিট ও ভ্যাকসিনের পুরনো বোতলসহ লাখ লাখ টনের মেডিক্যাল বর্জ্যের স্তূপ মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য আরও বেশি হুমকি হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ কথা জানিয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপুল পরিমাণ এই বর্জ্যের কারণে স্বাস্থ্য কর্মীরা অনেক সময়ই দগ্ধ বা আঘাতে ক্ষতের শিকার হতে পারেন। আবার এর মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সংস্পর্শে আসার আশঙ্কা রয়েছে বলেও স্বাস্থ্য সংস্থা উল্লেখ করেছে।
বাংলাদেশে মেডিক্যাল বর্জ্যের কারণে জনস্বাস্থ্য সবসময়ই হুমকিতে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। মেডিক্যাল বর্জ্য বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। এমনকি ২০২০ সালের ৯ জুন করোনার মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে আর খানের (রবিন) পাঠানো আইনি এই নোটিশে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশের বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ভাইরাস ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমিত হয়। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তির ব্যবহৃত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি থেকেও এ ভাইরাস সংক্রমিত হয়। কিন্তু দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহৃত পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস, সার্জিক্যাল মাস্ক নির্দিষ্ট কোনও ব্যবস্থাপনা ছাড়াই সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে যত্রতত্র ফেলায় দিন দিন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
করোনা সংক্রমণের পর থেকে দেশে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টন বর্জ্য তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়, এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতে ১ হাজার ৩১৪ টন সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস বর্জ্য ও ৪৪৭ টন সার্জিক্যাল মাস্কের বর্জ্য তৈরি হয়েছে। এ ধরনের বর্জ্যের সঠিক ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকায় পরিবেশের ক্ষতিসাধন ও পরিচ্ছন্ন কর্মীসহ দেশের জনগণ ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা বর্জ্যের মাত্র ৬ দশমিক ৬ ভাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা হয় বলে ২০২০ সালের অক্টোবরে জানিয়েছিল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। বাকি ৯৩ দশমিক ৪ ভাগ বর্জ্যই সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় নেই। ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি পরিচালিত ‘কোভিড-১৯ মহামারিকালে কার্যকর মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে।
ওই বছরের ২০ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণার ফলাফলে আরও জানানো হয়, সারাদেশে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ২৪৮ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মাত্র ৩৫ টন (১৪ দশমিক ১ শতাংশ) সঠিক নিয়মে ব্যবস্থাপনার আওতায় ছিল। এর অধিকাংশই আবার রাজধানী ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ এবং মাত্র একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অপসারণ ও শোধন করা হয়। বর্জ্য আলাদা করার ব্যবস্থাপনা থাকলেও, তা বিনষ্ট বা শোধন করার নিজস্ব কোনও ব্যবস্থাপনা নেই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর।
বাংলাদেশে মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থপনার কাজ করে বেসরকারি সংগঠন প্রিজম বাংলাদেশ। প্রিজম বাংলাদেশ জানায়, করোনাকালে গত দুই বছরে তারা রাজধানী ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড ২২টি হাসপাতালের মেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে কাজ করেছে।
মহামারির প্রথম বছরে অর্থ্যাৎ ২০২০ সালে এই হাসপাতালগুলো থেকে প্রতিদিন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ কেজি শুধু কোভিড বর্জ্যই সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে দিনে দিনে তার পরিমাণ কমে আসতে থাকে। একপর্যায়ে ৮০০ থেকে ৯০০ কেজি আর বর্তমানে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ কেজি মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ করে তার ব্যবস্থপনা করছে প্রিজম।
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানা যায়, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ২০০৮ সালে আইন পাস হয়, যদিও তার কার্যকারিতা খুবই কম। যে কারণে হাসপাতালের মেডিক্যাল বর্জ্য এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, যারা বর্জ্য নিয়ে কাজ করেন তারা যক্ষা, চর্মরোগসহ নানান অসুখে ভুগছেন। পাশাপাশি তারা নিউমোনিয়া, ডিপথেরিয়া, হেপাটাইটিস বি এবং সি ব্রংকিউলাইটিস, অ্যাজমা, হাঁপানিসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এমনকি সাধারণ মানুষও রয়েছে এই বর্জ্য অব্যবস্থাপনার ঝুঁকিতে।
মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, কোভিড-১৯ আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে, প্রকাশ করেছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনারও। কিন্তু এটা যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় না আসে তাহলে ভবিষ্যতে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ও পরিবেশগত ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছি আমরা।
প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার আনিসুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, করোনার শুরু থেকে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লোভসসহ নানা ধরনের বর্জ্য কিচেন ওয়েস্টেজের সঙ্গে মিলে গেছে। এটা কিন্তু মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। এ নিয়ে বাড়ি বাড়িতে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম হাতে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল দুই সিটি করপোরেশনে। কিন্তু দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি, যদিও উত্তর সিটি করপোরেশন কিছু কাজ করেছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু, কিন্তু চরম অবহেলিত’ বলে মনে করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোভিড থাকুক বা না থাকুক, মেডিক্যাল ওয়েস্টে ম্যানেজমেন্ট সবসময়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা যদি প্রোপার্লি হ্যান্ডেল না করতে পারি তাহলে সাধারণ মানুষের জন্যই যে অসুখ সংক্রমণের একট পথ তৈরি হয়।
‘এই মেডিক্যাল ওয়েস্টেজ ম্যানেজমেন্টের জন্য আইন রয়েছে, শাস্তির বিধান রয়েছে- সেগুলো কিছুই করা হচ্ছে না‘, বলেন অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান।
এমনকি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থ ব্যয় করলেও তারও ভোগ করা যাচ্ছে না বলে জানান অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘বড় বড় অনেক ইনসিনারেটর (বর্জ্য পোড়ানো মেশিন) কেনাও হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোথাও বসানোর জায়গা নেই। সরকার অনেক টাকা খরচ করে, কিন্তু দৃশ্যমান কোনও উন্নতি হয়েছে এটা আমি বলতে পারছি না।
‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এত নেগলেক্টেড’ আক্ষেপ করেন অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান। তিনি এর ঝুঁকি কথা তুলে ধরে বলেন, ‘মেডিক্যাল বর্জ্যের কারণে ফুসফুস, শ্বাসনালীর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এটাতে আনওয়ান্টেড রিস্ক এবং ইনজুরিও হতে পারে। এমনকি এইচআইভি পর্যন্ত হতে পারে। হেপাটাইটিস বি এবং সিতো রয়েছেই। তাই এসব চিকিৎসা বর্জ্যের জন্য বৈশ্বজুড়ে একটা প্রটোকল রয়েছে।’
গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান কনক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি এটা ভব্যিষতে অনেক বড় পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি করবে। আগে যে পলিথিন ব্যাগের কারণে ড্রেন বন্ধ হয়ে যেতো, আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে দেখা যাবে, মাস্কের কারণে ড্রেন বন্ধ হয়ে গেছে, জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।’
‘এমনিতেই সার্জিক্যাল মাস্কের ব্যবস্থপনা ঠিকমতো হচ্ছে না’ জানিয়ে ডা. রাশেদুল হাসান কনক বলেন, ‘এরসঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের মাস্ক, প্লাস্টিকের শিল্ড-গ্লাভস। সবমিলিয়ে এটা নিশ্চয়ই একটা হেলথ হ্যাজার্ড হবে। সম্প্রতি এমন অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে যার সঙ্গে মেডিক্যাল বর্জ্যের সর্ম্পক রয়েছে।’