বৃহস্পতিবার রাত। এক ফার্মেসি থেকে আরেক ফার্মেসি ছুটছেন সায়মন হাসান। ওষুধের দোকানে করোনা পরীক্ষা করার অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট খুঁজছেন তিনি। কলাবাগানের তাজরীন ফার্মেসির বিক্রেতারা জানালেন— এ কিট তো বিক্রির জন্য আসে না আমাদের কাছে। শুনে কিছুটা বিরক্ত হয়ে অন্য দোকানে যান সায়মন। বিক্রেতারা তখন নিজেরাই আলাপে বলছিলেন— কিট বিক্রির অনুমোদন আছে নাকি? থাকলে আমরা পাচ্ছি না কেন? মানুষ তো খুঁজছে!
রাজধানীর অনেক ফার্মেসিতেই এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়ছেন বিক্রেতারা। দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ার পর থেকেই মানুষ ফার্মেসিতে খুঁজতে যাচ্ছে টেস্ট কিট। এমনকি ফার্মেসিতে রাখা হয় না কেন, তা নিয়ে বাগবিতণ্ডার অভিজ্ঞতা আছে তাদের।
দেশে ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সরকারিভাবে করোনা পরীক্ষায় যুক্ত হয় র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে টেস্টের বিষয়ে পরামর্শ জানিয়ে বলেন, বিশ্বে বেশ কিছু অ্যান্টিজেন টেস্ট থাকলেও প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ২-৩টির বেশি ধরনের টেস্ট কিট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই যেগুলোর গ্রহণযোগ্য মাত্রার (কমপক্ষে ৮০ শতাংশ) সংবেদনশীলতা ও সুনির্দিষ্টতা রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কুইডেল করপোরেশনের সোফিয়া এসএআরএস অ্যান্টিজেন উচ্চমাত্রায় সংবেদনশীল (৯৭ শতাংশ) ও সুনির্দিষ্ট (১০০ শতাংশ)। কিন্তু এই টেস্টের জন্য নির্দিষ্ট একটি মেশিন প্রয়োজন যার আনুমানিক দাম আড়াই লাখ টাকা। কিটের দামও বেশি। এতে আনুমানিক প্রতি টেস্টে খরচ পড়বে ২ হাজার ৭০০ টাকা।
এখানে উল্লেখ্য যে, ‘সংবেদনশীল’ হচ্ছে একজন আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষাটি কতটুকু সঠিকভাবে করছে এবং ‘সুনির্দিষ্ট’ হচ্ছে ফলাফল কতটা সঠিক আসতে পারে তার মানদণ্ড।
এ ছাড়া রয়েছে এসডি বায়োসেন্সরের স্ট্যান্ডার্ড কিউ কোভিড-১৯ অ্যান্টিজেন। এই টেস্ট-এর জন্য কোনও মেশিন লাগে না। কিটের দামও কম। স্থানীয় সরবরাহকারীর তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি টেস্টের খরচ পড়ে প্রায় এক হাজার টাকা। বেশি পরিমাণে কেনা হলে সেই খরচ ৭০০-৮০০ টাকা হয়।
এর সুনির্দিষ্টতা শতকরা শতভাগ হলেও সংবেদনশীলতা কম (৮৪%)। ভারতে ব্যবহার করে এর সংবেদনশীলতা ৫০ শতাংশও পাওয়া গেছে। এর ফলে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করে ভুলভাবে নেগেটিভ ফল পাওয়ার আশঙ্কা আছে এতে। তাই অ্যান্টিজেন টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ হলেও নিশ্চিত হওয়ার জন্য পিসিআর/জিনএক্সপার্ট পদ্ধতিতে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করতেই হবে।
ওই পরামর্শকেই নির্দেশনা হিসেবে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে এবং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠিয়ে উপজেলা পর্যায়ে শুরু হয় অ্যান্টিজেন টেস্ট।
২০২১ সালের ডেল্টা তাণ্ডব শুরু হলে বেসরকারি পর্যায়ে অ্যান্টিজেন টেস্টের অনুমতি দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেখানে এসডি বায়োসেন্সর হিসেবে কোরিয়ার এবং যুক্তরাষ্ট্রের দুটি কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ২৪টি ব্র্যান্ডের কিটকে দেশে জরুরি ব্যবহারের জন্য ইমারজেন্সি ইউজ অথরাইজেশন দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। তবে সেই অনুমোদনের শর্তেই উল্লেখ ছিল এটা কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীসহ চট্টগ্রামেও খুচরা ও পাইকারি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট। ভারত এবং চায়নার কিট বলে বিক্রি হচ্ছে এসব। কিটের মূল্য একেক জায়গায় একেক রকম। কেউ খুচরা বিক্রি করছে ২০০ থেকে ১০০০ টাকায়। আবার বক্স বিক্রি হচ্ছে ১২ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকায়। ফেসবুকেও হচ্ছে প্রচারণা। সেখানে বলা হচ্ছে এ কিট ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদিত। যার ফরে অনলাইনে অর্ডার করে মানুষ ঘরে বসেও করোনা টেস্ট করছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর বলছে—এখন পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ে এসব কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বাইরে বিক্রি হলেও সেটা হবে নীতির লঙ্ঘন।
রাজধানীর কয়েকটি সার্জিক্যাল সামগ্রীর দোকান ঘুরে বিক্রির সত্যতা পাওয়া যায়। বিক্রেতারা ক্যাটালগ নিয়ে বসে বিক্রি করছেন অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট। ভারতের কোভির্যাট এবং চীনের লাইমিং বায়ো এবং ইনটেক ব্র্যান্ডের কিট কেনা যাচ্ছে সহজেই।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চীনের কিট সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত ডিলাররা সরবরাহ করে। দাম খুচরা ২০০-৩০০ টাকা। তাদের ভাষ্য—কিটের দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওঠানামা করে। অর্ডার দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে সরবরাহ করা যাবে বলেও জানান তারা।
ফেসবুকের বিভিন্ন পেজেও বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি হচ্ছে টেস্ট কিট। এ তালিকায় আছে চালডাল ডট কমও। তাদের ওয়েবসাইটে বর্তমানে ‘স্টক নেই’ দেখানো হচ্ছে। তবে তারা টেস্ট কিট সরবরাহ করে আসছিল বাংলামেডস নামক একটি অনলাইন ফার্মেসির মাধ্যমে, সম্প্রতি যে প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তারাই কিনে নিয়েছিল।
বাংলামেডের ওয়েবসাইটে ইনটেক ব্র্যান্ডের টেস্ট কিটের দাম রাখা হচ্ছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। আর স্ট্যান্ডার্ড কিউ ব্র্যান্ডের কিটের দাম ১৫ হাজার টাকা।
বাংলামেডের এক কর্মকর্তা জানান, ইমপোর্টার জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন আছে।
তবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন দেওয়া চিঠিতে এও উল্লেখ আছে কোথায় কোথায় এ কিট ব্যবহার করা যাবে।
এ ছাড়া আরও কয়েকটি ফেসবুক পেজে ব্যক্তি উদ্যোগেও বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট। এর মধ্যে আছে পল্টনের কার্ডিনাল কেয়ার, তানহা'স কালেকশন, স্মার্ট চয়েজ বিডি নামে কয়েকটি পেজ। তারা ঘরে বসেই টেস্ট করার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ফেসবুকে।
এ ছাড়া বিএমএ ভবনের পাশে সার্জিক্যাল মার্কেটের বেশ কয়েকটি দোকানেও বিক্রি হচ্ছে টেস্ট কিট। কার্ডিনাল কেয়ার জানিয়েছে এই মুহূর্তে স্টক শেষ, তবে দুই-একদিনের ভেতর পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান জানান, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদিত টেস্টিং করার সুবিধা যেখানে আছে সেখানে ছাড়া কোথাও কিট ব্যবহার করার অনুমোদন এখনও দেওয়া হয়নি। যদি কেউ বাইরে বিক্রি করে, আমরা সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের লাইসেন্স বাতিল করবো।’