গাজায় ইসরায়েলের পূর্ণ অবরোধ

বিমান হামলার চেয়ে দুর্ভিক্ষকে বেশি ভয় পাচ্ছেন গাজাবাসী

সাত সপ্তাহ ধরে চলা ইসরায়েলি সামরিক অবরোধ গাজাকে এক নতুন স্তরের হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক ও মানবিক সহায়তা কর্মীরা। এই নজিরবিহীন অবরোধের ফলে পুরো গাজা উপত্যকা মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে।

এই অবরোধের কারণে ফিলিস্তিনি এই ভূখণ্ডটি এমন এক চরম অবস্থার মধ্যে পড়েছে, যা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ। বাসিন্দারা এখন নতুন করে স্থানচ্যুতির আদেশ, হাসপাতালের মতো বেসামরিক অবকাঠামোর ওপর নতুন করে বোমাবর্ষণ, খাদ্য, জেনারেটরের জন্য জ্বালানি এবং চিকিৎসা সামগ্রীর ঘাটতির মুখোমুখি।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে গাজাবাসী জানিয়েছেন, এখন তারা বিমান হামলার চেয়েও দুর্ভিক্ষকে বেশি ভয় পাচ্ছেন। উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ার ৪৪ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষক হিকমত আল-মাসরি বলেছেন, অনেকবার আমাকে আমার ছেলের জন্য নিজের খাবার ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমাকে যে জিনিসটা মেরে ফেলবে, তা হলো ক্ষুধা।

দুই মাসের যুদ্ধবিরতির সময় মজুত করা খাবার এখন শেষ হয়ে গেছে, এবং গোটা উপত্যকায় হতাশ মানুষ খালি হাঁড়ি-বাসন নিয়ে দাতব্য রান্নাঘরের সামনে ভিড় করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজারে পণ্যের দাম যুদ্ধবিরতির সময়ের তুলনায় এখন ১৪০০ শতাংশ বেড়েছে।

নতুন ইসরায়েলি সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশে আনুমানিক ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ আবার পথে নেমেছেন। যার ফলে ক্ষুধা ও অপুষ্টি নিয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে অক্সফামের হিসেব অনুযায়ী, বেশিরভাগ শিশু এখন দিনে এক বেলারও কম খাবার খেয়ে বেঁচে আছে।

হতাশ চোখে পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি দেখছে গাজাবাসী। ছবি: রয়টার্স।

প্রায় ৯৫ শতাংশ ত্রাণ সংস্থা বিমান হামলা ও অবরোধের কারণে তাদের কার্যক্রম স্থগিত বা সীমিত করেছে এবং ফেব্রুয়ারি থেকে গাজায় আন্তর্জাতিক কর্মীদের প্রবেশের ওপর ইসরায়েল কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এমনকি ব্যথানাশক ওষুধের মতো মৌলিক চিকিৎসা সামগ্রীও শেষ হয়ে যাচ্ছে।

এই অবরোধের সঙ্গে গাজার উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণের রাফাহ শহরে ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণ তীব্র হয়েছে। যার ফলে গাজা পুরোপুরি মিসরের সঙ্গে সংযোগ হারিয়েছে।

জাতিসংঘের মতে, গাজার প্রায় ৭০ শতাংশ অঞ্চল এখন ইসরায়েলি সরিয়ে নেওয়ার আদেশাধীন অথবা সামরিক বাফার জোনে পরিণত হয়েছে। রাফাহতে নতুন নিরাপত্তা অঞ্চল পুরো ভূখণ্ডের এক-পঞ্চমাংশ।

এই জমি দখলের ফলে ২৩ লাখ মানুষের বসবাসের ক্ষেত্র, ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তার সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।

দুই মাসের যুদ্ধবিরতি একতরফাভাবে বাতিল করে ইসরায়েল মার্চ থেকে গাজায় গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। যুদ্ধবিরতি চলাকালীন সরিয়ে নেওয়া স্থলবাহিনীও আবার মোতায়েন করা হয় এবং বড় পরিসরে বোমাবর্ষণ শুরু হয়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলার সময় আটক রাখা বাকি জিম্মিদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত সহায়তা সরবরাহ চালু করা হবে না—এই বক্তব্য বারবার পুনর্ব্যক্ত করেছে ইসরায়েলি সরকার। তারা এই অবরোধকে একটি নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরেছে এবং যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অভুক্ত রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। যদিও এটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।

এই অবরোধ এখন অষ্টম সপ্তাহে প্রবেশ করছে, যা ১৮ মাসের যুদ্ধে গাজা উপত্যকার ওপর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ।

এদিকে নিরাপত্তা বাফার জোন তৈরির জন্য ফিলিস্তিনি জমি দখলের প্রক্রিয়াও চলছে এবং ইসরায়েল সেনাবাহিনী ও বেসরকারি ঠিকাদারদের মাধ্যমে সহায়তা সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনাও করছে। এতে গাজার মানুষ আশঙ্কা করছে, ইসরায়েল দীর্ঘমেয়াদে তাদের ভূখণ্ডে সেনা মোতায়েন রাখবে এবং ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত করবে।

ইসরায়েলি হামলায় গাজার ধ্বংসস্তূপ। ছবি: এপি।

মানবিক সহায়তা কর্মীরা বলছেন, তারা আশঙ্কা করছেন যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ম পরিবর্তিত হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে তারা খান ইউনিসের নাসের হাসপাতাল ও গাজা সিটির আল-আহলি হাসপাতালের ওপর সাম্প্রতিক হামলার কথা উল্লেখ করছেন।

নাসের হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মেডিকেল টিমের সদস্যরা অবস্থান করছিলেন, সেখানে হামলায় দুজন নিহত হয়েছেন। আল-আহলিতে কেউ নিহত না হলেও হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ও সার্জারি বিভাগ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ ত্রাণ কর্মকর্তা বলেছেন, গাজার মানুষ আন্তর্জাতিক কর্মীদের চারপাশে থাকতে পছন্দ করে, কারণ এতে মনে করে তারা নিরাপদ, এবং ইসরায়েলি সেনারা ওই ভবন বা এলাকায় হামলা কম চালাবে।

আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীরা যুদ্ধবিরতি আলোচনা পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন, তবে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের মতো মূল বিষয়গুলোতে উভয় পক্ষের মধ্যে আপোসের খুব একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বেইত লাহিয়ার প্রভাষক মাসরি বলেন, ‘যখন অবরোধ আবার চাপিয়ে দেওয়া হলো এবং যুদ্ধ শুরু হলো, আমি আতঙ্কে ছিলাম। আমি সবসময় আমার ছোট ছেলের কথা ভাবি, কীভাবে আমি তাকে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেব। কেউ কল্পনাও করতে পারবে না আমাদের দুঃখ-কষ্ট কতটা… মৃত্যু আমাদের চারপাশেই ঘুরছে।’

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান