লেবাননের শিয়া সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে নিরস্ত্রীকরণের চাপ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়া এবং সিরিয়ায় মিত্র বাশার আল-আসাদের পতনের পর সংগঠনটি এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায়। এই সুযোগে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপে হিজবুল্লাহকে অস্ত্র ত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা চলছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শর্তহীনভাবে হিজবুল্লাহ অস্ত্র ত্যাগ করবে না। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
৬ এপ্রিল লেবানন সফরে গিয়ে মার্কিন উপ-বিশেষ দূত মরগান অরটাগাস স্থানীয় একটি টেলিভিশনকে বলেন, হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে হবে। ইসরায়েল কখনোই সন্ত্রাসীদের গুলি সহ্য করবে না।
অন্য একটি সাক্ষাৎকারে তিনি হিজবুল্লাহকে ক্যানসারের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, একে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে অপসারণ করতে হবে। অরটাগাস লেবাননের ব্যাংকিং খাতে সংস্কারেরও তাগিদ দেন, যাতে হিজবুল্লাহর অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
গত বছর ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতৃত্বের পতন হয়েছে, শতাধিক শিশুসহ কয়েকশ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।
হিজবুল্লাহ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে নিরস্ত্রীকরণের ঘোষণা দেয়নি। তবে সংগঠনটি জানে, লেবাননের পুনর্গঠনের জন্য বিদেশি সাহায্য প্রয়োজন। পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কারিম সাফিয়েদ্দিন বলেছেন, নীতিগতভাবে হিজবুল্লাহ অস্ত্র ত্যাগ করবে না। তবে বড় কোনও সুবিধা পেলে তারা তা বিবেচনা করতে পারে।
রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইসরায়েল যদি দক্ষিণ লেবাননের দখলকৃত পাঁচটি স্থান ছেড়ে দেয়, তাহলে হিজবুল্লাহ নিরস্ত্রীকরণ বিবেচনা করতে পারে। তবে পরে সংগঠনটি এই খবরটি নাকচ করে। হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষক কাসেম কাসির বলেছেন, ইসরায়েলি দখল থাকা অবস্থায় নিরস্ত্রীকরণ আলোচনা অসম্ভব। তবে ইসরায়েল সরে গেলে কী হবে, তা বলা কঠিন।
লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আওন বারবার বলেছেন, রাষ্ট্রই একমাত্র অস্ত্রের নিয়ন্ত্রক হওয়া উচিত। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও তাকে সমর্থন দিয়েছেন। তবে মার্কিন প্রশাসন ও লেবাননের কিছু গোষ্ঠী আরও কঠোর পদক্ষেপ চাইছে।
লেবানিজ ফোর্সেস (এলএফ) নামের একটি খ্রিস্টান দল হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। দলটির নেতা সামির জাজিয়া বলেছেন, ছয় মাসের মধ্যে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে হবে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এলএফের এই চাপে সরকার বা হিজবুল্লাহ নড়বে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হিজবুল্লাহর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে ওয়াশিংটন ও তেহরানের আলোচনায়। গত শনিবার ওমানে এবং আগামী সপ্তাহে রোমে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনা হয়েছে। যদিও আলোচনার মূল বিষয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, তবে হিজবুল্লাহসহ ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর বিষয়ও উঠতে পারে।
বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হিলাল খাশান বলেছেন, ইরান বুঝতে পেরেছে, পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হলে লেবানন, ইয়েমেন ও ইরাকে তাদের সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। হিজবুল্লাহর নিরস্ত্রীকরণ লেবাননের অভ্যন্তরীণ চাপে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের চাপেই ঘটবে।
কয়েকজন বিশ্লেষক সতর্ক করে বলছেন, হিজবুল্লাহর সমর্থক শিয়া সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়। সাফিয়েদ্দিন বলেছেন, শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি নতুন সামাজিক পরিচয় তৈরি করতে হবে, যাতে তারা রাষ্ট্রকেই তাদের স্বার্থের প্রতিনিধি মনে করে। যুক্তরাষ্ট্র এটি করতে পারবে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এগুলো গৌণ বিষয়। মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টায় স্থানীয় বিষয়গুলো তারা প্রায়ই উপেক্ষা করে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের নাতাশা হল বলেছেন, গত দেড় বছর দেখিয়েছে, ফিলিস্তিন, লেবাননের শাসনব্যবস্থা, ইয়েমেন বা সিরিয়ার সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তবুও তারা তা করতে চেষ্টা করছে।
হিজবুল্লাহ নিজের ৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিরস্ত্রীকরণের কাছাকাছি পৌঁছেছে। তবে এই প্রক্রিয়া কতটা শান্তিপূর্ণ হবে, তা এখনও অনিশ্চিত। লেবাননের নাজুক রাজনৈতিক ভারসাম্য ও হিজবুল্লাহর সমর্থকদের ভূমিকা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলতে পারে।