মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কর্মকর্তা আসিফ রহমানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক হামলার গোপন তথ্য ইরানে ফাঁসের অভিযোগে মামলা দায়েরের ঘটনা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা যুদ্ধের আরেকটি নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনা শুধু মার্কিন প্রশাসনকেই বিব্রত করেনি, বরং গোটা অঞ্চলজুড়ে এক অন্তহীন ছায়াযুদ্ধের প্রকৃতি তুলে ধরেছে।
তথ্য ফাঁস ও আন্তর্জাতিক সংকট
ইরান-ভিত্তিক একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে এই তথ্য ফাঁস করা হয়, যা ইরানের সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে দাবি করা হয়েছে। তবে, বিষয়টি মার্কিন প্রশাসনের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এর আগে পেন্টাগনের নথি ফাঁসের ঘটনায় আরেক কর্মকর্তা জ্যাক টেক্সেইরা দোষী সাব্যস্ত হন।
এই তথ্য ফাঁস ইরান, ইসরায়েল ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধের একটি আংশিক চিত্র তুলে ধরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দ্বন্দ্ব শুধু সামরিক কৌশল নয়, বরং জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণের দিকেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।
একপক্ষের জয়, অন্যপক্ষের পরাজয়
অক্টোবরে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত জানিয়েছিল, ইরানের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে সাতজন ইসরায়েলি নাগরিককে আটক করা হয়েছে। এর একদিন আগে হাইফা থেকে আরও সাতজনকে একই অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
ইসরায়েলি পুলিশের দাবি, ইরান সংশ্লিষ্ট আরও গুপ্তচর সেল দেশে সক্রিয় রয়েছে। এদিকে, সেপ্টেম্বর মাসে ৭৩ বছর বয়সী ব্যবসায়ী মোতি মামানকে ইরানি গোয়েন্দাদের সঙ্গে কাজ করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হত্যার পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ইরানও বেশ কয়েকজন নাগরিককে আটক করেছে। ডিসেম্বর মাসে মোসাদের হয়ে কাজ করার অভিযোগে তিনজন পুরুষ ও একজন নারীকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
মানব গুপ্তচরের গুরুত্ব
ডিজিটাল নজরদারি এবং সামাজিক মাধ্যম পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত কার্যকর হলেও মানব গুপ্তচরের গুরুত্ব এখনও অপরিসীম। সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির সিনিয়র ফেলো সিনা তুসি বলেন, ইরান ও ইসরায়েলের চলমান ছায়াযুদ্ধে মানব গোয়েন্দার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইসরায়েল হাই-প্রোফাইল হত্যাকাণ্ড এবং অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ইরানে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে, ইরানও মানব গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে ইসরায়েলে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সমাজের ভাঙন ও গোয়েন্দা অনুপ্রবেশ
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ বিভাজন ইরানকে সেখানে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। বিশ্লেষক হামজা আত্তার বলেন, ইসরায়েলি সমাজের ভাঙন ইরানের গোয়েন্দা কার্যক্রম সহজতর করছে।
হাইফায় আটক হওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই আজারবাইজান থেকে আসা অভিবাসী বা আরব-ইসরায়েলি সম্প্রদায়ের সদস্য। এটি ইরানকে ভবিষ্যতে আরও অনুপ্রবেশের সুযোগ দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ইরানে ইসরায়েলের প্রভাব
ইসরায়েল বহুদিন ধরে ইরানের ভেতরে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিশেষজ্ঞ আহরন ব্রেগম্যান বলেন, ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর থেকেই ইরান সরকারের পতন ঘটানো ইসরায়েলের লক্ষ্য।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রমের সফলতার মধ্যে রয়েছে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার অন্তর্ঘাত এবং ইরানের গভীর অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা।
মিথ্যা প্রচার: একটি শক্তিশালী হাতিয়ার
গোটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ইরান মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে প্রতিপক্ষের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির কৌশল ব্যবহার করছে। সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের ফেলো ভিনা আলি-খান বলেন, ইরান প্রায়ই ভুয়া খবর ছড়িয়ে প্রতিপক্ষের বিশ্বাসযোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রচেষ্টা
শিন বেত ও ইসরায়েলি পুলিশ নিয়মিত তাদের অভিযান জনসমক্ষে তুলে ধরে জনমনে সতর্কতা সৃষ্টি করতে চায়। তবে এই প্রচার অভিযানের পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতাও লুকিয়ে রয়েছে, বিশেষ করে ৭ অক্টোবর হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থতার ঘটনা।
সিনা তুসি বলেন, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সক্ষমতা অত্যন্ত উন্নত হলেও তাদের বর্তমান কৌশলগত পরিস্থিতি ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
আল জাজিরা অবলম্বনে।