লেবাননের বিস্ফোরণে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র যোগসাজশ?

লেবাননের বিভিন্ন স্থানে মঙ্গল ও বুধবার বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ২৬ জন নিহত এবং তিন হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, শত শত পেজারে বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা সত্ত্বেও, এই ঘটনার পেছনে ইসরায়েলের হাত থাকার অভিযোগ তুলেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ইসরায়েল একটি গোপন অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে হিজবুল্লাহর জন্য আমদানি করা তাইওয়ানি পেজারের মধ্যে বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলো নামক একটি কোম্পানির তৈরি পেজারগুলো হিজবুল্লাহ অর্ডার করেছিল।

অজ্ঞাত সূত্রের দাবি অনুযায়ী, পেজারগুলোর বেশিরভাগই ছিল এআর-৯২৪ মডেলের। এই পেজারগুলোর ব্যাটারির পাশে ৩ গ্রামের মতো বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল। যা দূর থেকে একটি রিমোট ট্রিগারের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভবপর ছিল।

সন্দেহভাজন নাশকতা
লেবাননের স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় পেজারগুলোতে একটি বার্তা আসে। মনে হয়েছিল এসব বার্তা হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব থেকে এসেছে। আসলে এই বার্তা পেজারে লুকিয়ে রাখা বিস্ফোরককে সক্রিয় করে। কর্মকর্তাদের দাবি, পেজারগুলো কয়েক সেকেন্ড ধরে শব্দ করার পরই বিস্ফোরণ ঘটে।

একজন লেবানিজ কর্মকর্তা বলেন, ডেটা নির্দেশ করে যে ডিভাইসগুলো প্রি-প্রোগ্রাম করা হয়েছিল এবং ব্যাটারির পাশে বিস্ফোরক রাখা ছিল।

তিনি আরও জানান, তদন্তকারীরা এখন বিস্ফোরকের প্রকার ও পেজারের উৎস শনাক্ত করতে কাজ করছে।

তদন্তে জড়িত এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, কিছু ডিভাইস পরীক্ষা করা হচ্ছে, কিন্তু বেশিরভাগই বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে। ডিভাইসের লিথিয়াম ব্যাটারি গরম হয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর সম্ভাবনা কম। কারণ লিথিয়াম ব্যাটারির বিস্ফোরণ সাধারণত ছোট আগুনের সৃষ্টি করে। এতে ছোটখাটো পোড়া সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এই বিস্ফোরণগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল।

হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, যেসব পেজার বিস্ফোরিত হয়েছে, সেগুলো হিজবুল্লাহর সম্প্রতি আমদানি করা একটি চালানের অংশ ছিল। এগুলোতে উৎপাদনের সময়েই নাশকতা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র যোগসাজশ
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, হিজবুল্লাহ ও লেবাননের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ব্যবহৃত ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন ডিভাইসে বিস্ফোরণের ঘটনায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমন্বয় ছিল। যদিও এর আগে ওয়াশিংটন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল।

ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচার সংস্থা কেএএন জানায়, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন মঙ্গল ও বুধবারের বিস্ফোরণের আগেই দুবার ফোনে কথা বলেছিলেন। প্রথমবারের ফোনালাপ হয়েছিল লেবাননে প্রথম বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট আগে। আর দ্বিতীয়টি হয়েছিল দ্বিতীয় দফার বিস্ফোরণের আগে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কোনও ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে।

রাষ্ট্র পরিচালিত গুপ্তচরবৃত্তি
পেজারগুলো কখন অর্ডার করা হয়েছিল এবং লেবাননে কখন পৌঁছেছিল তা এখনও পরিষ্কার নয়। ইসরায়েল এই ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত বা অস্বীকার না করলেও, তাদের আন্তঃসীমান্ত নাশকতার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

ইসরায়েলের অন্যতম কুখ্যাত অপারেশনগুলোর মধ্যে একটি হলো এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার। এই সফটওয়্যারটি বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট ও রাজনৈতিক নেতাদের ফোন হ্যাকিং করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরব, ভারত, মেক্সিকো ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে স্পাইওয়্যারটি ব্যবহার করা হয়েছে।

এছাড়া, স্টাক্সনেট ওয়ার্মের মতো সাইবার অস্ত্র ব্যবহার করে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রোগ্রাম ধ্বংস করেছিল ইসরায়েল। যা সাইবার অস্ত্রের মাধ্যমে অবকাঠামোগত ধ্বংস সাধনের প্রথম উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ইসরায়েলের এই প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিশ্বব্যাপী গুপ্তচরবৃত্তি, নজরদারি ও নাশকতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড