ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং হামাসের তিন সিনিয়র কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর করিম খান। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় এবং ইসরায়েলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ এনে এই আবেদন করেছেন তিনি। তার এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে ইসরায়েলি মিত্র ইউরোপীয় তিনটি দেশ ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও স্লোভানিয়া, যা ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা করতে মঙ্গলবার ফ্রান্সে গেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি এই খবর জানিয়েছে।
এই মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলে ইসরায়েল বৈশ্বিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। গাজায় যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ঘনিষ্ঠ মিত্রদের কাছ থেকেও ক্রমবর্ধমান সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে দেশটি। এমনকি গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তিনটি দেশের সমর্থন ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ করছে।
এ নিয়ে অনেকটা চাপের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল। দেশটির নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং সম্ভাব্য হুমকি নিয়ে আলোচনা করতে মঙ্গলবার ফ্রান্সে গেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ।
এদিকে, ইসরায়েলকে এখনও পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে দেশটির ঘণিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো। তারা আইসিজে এর সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। তবে যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়, তা নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের জন্য আন্তর্জাতিক ভ্রমণকে আরও জটিল করে তুলবে। এমনকি তারা যদি তাৎক্ষণিক বিচারের ঝুঁকির সম্মুখীন না-ও হন, তবুও। কেননা, আন্তর্জাতিক আদালতের সদস্য নয় ইসরায়েল।
ইসরায়েলি নেতারা ছাড়াও হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার, মোহাম্মদ দেইফ এবং ইসমাইল হানিয়াহের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন করেছেন প্রসিকিউটর করিম খান। হামাসকে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে পশ্চিমারা। ধারণা করা হচ্ছে, সিনওয়ার এবং দেইফ দুজনেই গাজায় গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তবে হামাসের সর্বোচ্চ নেতা হানিয়াহ বর্তমানে কাতারে অবস্থান করছেন। তিনি প্রায়ই এই অঞ্চলে ভ্রমণ করে থাকেন। ইসরায়েলের মতো কাতারও আইসিসির সদস্য নয়।
গ্রেফতারি পরোয়ানা সংক্রান্ত অনুরোধের বিষয়ে সোমবার রাতে এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে ইসরায়েলের মিত্র দেশ ফ্রান্স। ওই বিবৃতিতে দেশটি বলেছে, তারা ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, এর স্বাধীনতা এবং সব পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইকে সমর্থন করে।’
ওই বিবৃতিতে ইসরায়েলকে ‘আন্তর্জাতিক মানবিক আইন কঠোরভাবে মেনে চলার বাধ্যবাধকতা এবং বিশেষ করে গাজা উপত্যকায় বেসামরিকদের অগ্রহণযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির ও অপর্যাপ্ত মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার বিষয়ে ফ্রান্স কয়েক মাস ধরেই সতর্ক করে আসছে’ বলে উল্লেখ করা হয়।
ফ্রান্সে একটি বিশাল ইহুদি সম্প্রদায় রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে দেশটির।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছিলো ইসরায়েল। ওই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েরি নিহত হন। তাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক। তখন আরও প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় প্রতিরোধ যোদ্ধারা। প্রসিকিউটর করিম খান হামাসের নেতাদের নির্মূল, হত্যা এবং যৌন সহিংসতাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
হামাসের হামলায় প্রতিক্রিয়ায় ওইদিনই গাজায় পালটা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, অঞ্চলটিতে এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই যুদ্ধের কারণে গাজা উপত্যকায় একটি মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। অঞ্চলটির কিছু অংশে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষও। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অনাহারকে ‘যুদ্ধের পদ্ধতি’ হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ করেছেন প্রসিকিউটর করিম খান।
সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে করা একটি পোস্টে বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাদজা লাহবিব বলেছেন, ‘অপরাধী নির্বিশেষে গাজায় সংঘটিত অপরাধের অবশ্যই সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিচার করা উচিত।’
প্রসিকিউটরের এই পদক্ষেপকে লজ্জাজনক এবং ইহুদিবিরোধী বলে নিন্দা করেছেন নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য ইসরায়েলি নেতারা। এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও। হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন তিনি। আইসিজে এর পদক্ষেপ ‘সহায়ক নয়’ বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাজ্য। দেশটি বলেছে, এই মামলায় আইসিসির কোনও এখতিয়ার নেই।
অন্যদিকে, করিম খানের এমন সিদ্ধান্তকে ‘ভয়াবহ এবং সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছে ইসরায়েলের মিত্র দেশ চেক প্রজাতন্ত্র।
এই বিষয়ে একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং একটি মামলা দায়ের করা হবে কিনা এ নিয়ে তিন বিচারকের একটি বেঞ্চ সিদ্ধান্ত নেবে। এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে সাধারণত দুই মাস সময় নিয়ে থাকেন বিচারকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনও ধরণের গ্রেফতারি পরোয়ানা ইসরায়েল ও তার মিত্রদের মধ্যকার সম্পর্ক জটিল করে তুলবে, যদিও সেসব মিত্ররা আইসিজে এর পদক্ষেপের নিন্দা করছে।
ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইউভাল ক্যাপলিনস্কি বলেছেন, এই আদালতের সদস্য দেশগুলোতে নেতানিয়াহু বা গ্যালান্ট যদি ভ্রমণ করলে তাদের গ্রেফতার করার এখতিয়ার রয়েছে। তবে এসব দেশের মধ্যে কিছু দেশ আইনী ফাঁকফোকর খুঁজে পেতে পারে যা তাদের গ্রেফতার এড়াতে সহায়তা করবে।