ভারতের প্রতিরক্ষা খাতের বরাদ্দ তিন লাখ কোটি রুপি ছাড়িয়ে গেছে, যা একটি রেকর্ড। দেশটির সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া পক্ষকে এমন বাজেট খুশি করবে। কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিরক্ষা বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের ধারণা, বেসামরিক রাজনীতিবিদরা দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পূর্ণভাবে বুঝতে সক্ষম নন। ২০১৪ সালের পর থেকে এদের সংখ্যা ‘আশঙ্কাজনকভাবে’ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজেদের দাবির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তারা ভারতের ইতিহাস ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলেন। ভারত পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যখানে রয়েছে। এই দুই দেশের সঙ্গেই তার রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত।
পাকিস্তান ও চীনের বাড়তে থাকা সুসম্পর্কের প্রেক্ষিতে ভারতের উচিত হবে না দুই ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার। এটা সত্যি যে ২১ হাজার কোটি রুপির বাড়তি বরাদ্দ প্রতিরক্ষা খাতের জন্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে অনেক বড় একটি উদাহরণ। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, এমন বিশাল পরিমাণ অর্থের বরাদ্দ শেষ পর্যন্ত ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে সমর্থ নাও হতে পারে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি কার্যকর হওয়ার মধ্যে দিয়ে শুধু আফগানিস্তান বিপদে পড়বে না, সেই সঙ্গে বিপদ বাড়বে ভারতেরও। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মার্কিন সেনা প্রত্যাহার হয়ে গেলে একদিকে যেমন বাড়তে পারে জঙ্গি তৎপরতা অন্যদিকে তেমন বাড়তে পারে কাশ্মিরে গেরিলা হামলা। একই পরিস্থিতি দেখা যেতে পারে ভারতের অন্যান্য স্থানেও। আর এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে বড়জোর বছর দুই লাগতে পারে। ভারতের যে সেনা সদস্যরা এমনিতেই কাশ্মিরে পরিখার মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, সেখানে দেখা যাবে, তাদের মোকাবেলার সাধ্যের চাইতেও বড় বিপদ এসে উপস্থিত হয়েছে।
আফগান তালেবান এখন তাদের সীমান্তের মধ্যে তৎপরতা চালায়, নিজেদের রক্ষা করা নিয়েই ব্যস্ত তারা। কিন্তু মার্কিন সেনাবাহিনী চলে গেলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। আর সেক্ষেত্রে টিকে থাকাটা আফগান সরকারের পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়ে উঠবে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র কোনও ঘাঁটি রাখবে না। বরং একটি আউটপোস্ট রাখবে। আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এটি একই সঙ্গে পাকিস্তান, ভারত ও ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার স্তিতসিলতার জন্য খুবই ক্ষতিকারক।
ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কখনওই পর্যাপ্ত ছিল না। এর অস্ত্র থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি দ্রুত পরিবর্তন করা প্রয়োজন। ২০১৪ সালে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে নরেন্দ্র মোদি সেনাবাহিনীর সরঞ্জাম হালনাগাদ করার কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত ধীর। প্রায় একযুগের ‘আত্মপ্রসাদের কাল’ শেষে এখন মাত্র ২১ হাজার কোটি রুপি বাড়তি বরাদ্দ দিয়ে খুব বেশি কিছু করা যাবে না।
ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাদের মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সব সিদ্ধান্তই যেন ভারতকে অর্থনৈতিক, রাজনীতি ও সামরিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নির্ধারিত হচ্ছে। এরই মধ্যে এমন সংকেত দেওয়া হয়েছে, ভারত যদি দাবি না মানে তাহলে দিল্লির বিরুদ্ধেও অবরোধ আরোপ করা হবে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে এই বিষয়টি জোরালো হয়ে উঠেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন চায় না, তাদের সেনা সদস্যরা আর অন্য কোথাও গিয়ে নিজেদের রক্ত ঝরাক। পরোক্ষভাবে কোনও যুদ্ধে সহায়তা চালিয়ে যেতে তারা রাজি; যেমন সিরিয়ায়। ভবিষ্যতে বিশ্বের অন্য কোথাও ‘গণতন্ত্র রক্ষার জন্য’ অভিযান চালাতে হলে ট্রাম্প বরং তার ইউরোপীয় সহযোগীদের দিকেই প্রত্যাশা করবেন বেশি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেকোনও অভিযানের বিষয়ে যেমন এখন ইউরোপের বর্ধিত অংশগ্রহণ চাইছেন, তেমনটা চাইছেন ভারতের কাছেও। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার হয়ে গেলে আফগানিস্তানে তার স্বার্থ নিশ্চিত করতে ভারতকে আরও অনেক বেশি কার্যকর অবদান রাখতে হবে।
এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতকে খুব সহসাই আফগানিস্তান ও তালেবানের সঙ্গে স্মপর্কোন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে। এদের দুই পক্ষের আবার পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারত শুধুমাত্র কূটনৈতিক দিক থেকেই পদক্ষেপ নিয়েছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাওয়ার ইচ্ছে আছে তার। উত্তরের সীমান্তে ভারত কিছু মাত্রায় সমঝোতা নিশ্চিত করতে পেরেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার করিডোর প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু বিষয়ে ছাড় দিয়েছে।
ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে কিনেছে বিশাল পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য সরঞ্জাম। ভারত ধীরে ধীরে তার সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যদিও তালেবান ও তার পাকিস্তানি সহযোগীদের কারণে কাশ্মিরে খুব সহজে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামলাতে যে ভারত সক্ষমতা বাড়াতে চায় তা তার প্রাণ মেলে এবারের বর্ধিত বাজেট বরাদ্দের মধ্য দিয়ে। অবশ্য অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একটি রক্তাক্ত সংঘর্ষই অপেক্ষা করছে।