যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের সময় ইউরোপ একটি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের সরকারের পতন এবং ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হওয়া এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউরোপের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর জানিয়েছে।
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন ইউরোপের নেতৃত্বের সংকটকে আরও গভীর করেছে। ইউরোপীয় নেতাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ঐক্য বজায় রাখা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করা। তবে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বুধবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে হলো যখন ইউরোপে নেতৃত্বের অভাব ও ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়াকে নতুনভাবে আকার দিচ্ছে। জার্মানির সাবেক রাষ্ট্রদূত উলফগ্যাং ইশিঙ্গার বলেছেন, এটি অত্যন্ত খারাপ সময়। জার্মানি এখন নির্বাচনপ্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইশিঙ্গার আরও জানান, নির্বাচনের পর ফ্রিডরিখ মের্জের নেতৃত্বাধীন একটি নতুন সরকার গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে গঠনমূলক যোগাযোগ করতে সক্ষম হবে। তবে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইউরোপের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সম্প্রতি ইউক্রেনে একটি ইউরোপীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রস্তাব ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে খুব বেশি সমর্থন পায়নি। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক সংকট ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এদিকে, জার্মানিতে অর্থনৈতিক মডেল নিয়ে বিতর্ক এবং ফ্রান্সে সংসদীয় নির্বাচন থেকে উদ্ভূত অচলাবস্থা নেতৃত্বের অভাব আরও প্রকট করছে।
ট্রাম্পের প্রশাসনের কর্মকর্তারা সম্প্রতি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি বাফার জোন তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি ৪০ হাজার ইউরোপীয় সেনা দিয়ে পাহারা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে, এই প্রস্তাব বার্লিন ও লন্ডনে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। ইউরোপীয় নেতারা মনে করছেন, এই ধরনের উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের গবেষণা পরিচালক জেরেমি শ্যাপিরো বলেছেন, এই প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়, তবে এটি রাজনৈতিক নাটকের একটি অংশ। ইউরোপীয় নেতাদের এখন নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করে এই ধরনের বিতর্কিত প্রস্তাবগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টির সরকার ক্ষমতায় এলেও অর্থনৈতিক সংকট এবং অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান দেশটির ভূমিকা সীমিত করছে। প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করলেও ব্রেক্সিট-পরবর্তী পরিস্থিতি তার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে। স্টারমারের তৎপরতা সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে দুর্বল রয়ে গেছে।
ইতালির ডানপন্থি প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ও পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক ইউরোপীয় নেতৃত্বে ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা দেখিয়েছেন। বিশেষত, পোল্যান্ড আগামী বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাউন্সিলের সভাপতিত্ব করবে। তবে, এই দুটি দেশ ইউরোপীয় নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাহী শাখা ইউরোপীয় কমিশন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাইলেও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্বের অভাব ট্রাম্পের ইউরোপবিরোধী মনোভাবকে আরও শক্তিশালী করছে। জার্মানির সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার রিকেটস বলেন, ইউরোপের প্রধান দেশগুলোর এতটা দুর্বল অবস্থা আগে কখনও দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের সম্ভাব্য নীতিগুলোর ফলে ইউরোপের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা আরও প্রকট হয়েছে। ট্রাম্প যদি ইউক্রেন ইস্যুতে তার অবস্থান বদলান, তবে ইউরোপীয় নেতাদের জন্য সমন্বিত প্রতিক্রিয়া জানানো কঠিন হয়ে যাবে।
জার্মানির সাবেক রাষ্ট্রদূত এমি গুটম্যান বলেন, এই মুহূর্তে জার্মানি ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক। তবে অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।