শিল্প উৎপাদন ও ভোক্তা ব্যয়ের চাপে থাকা চীনের অর্থনীতি চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) প্রত্যাশার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপিয়ে দেওয়া উচ্চ শুল্কের কারণে আগামী দিনগুলোতে এই গতি ব্যাহত হতে পারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য এটি দশকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
বুধবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম প্রান্তিকে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, যা গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকের সমান। রয়টার্সের এক জরিপে বিশ্লেষকরা ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তবে, মার্কিন শুল্কের প্রভাবে রফতানি খাত সংকুচিত হতে শুরু করলে দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে প্রবৃদ্ধির গতি কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ট্রাম্প সম্প্রতি চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছেন, যার জবাবে বেইজিংও মার্কিন পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। এই বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।
নোমুরার অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের অর্থনীতিতে একই সময়ে দুটি বড় চাপ কাজ করছে—অভ্যন্তরীণভাবে অচলাবস্থায় থাকা রিয়েল এস্টেট খাত এবং বাইরে থেকে মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সিনিয়র ইকোনমিস্ট জু তিয়ানচেন বলেন, মার্কিন শুল্কের অতিরিক্ত চাপ মোকাবিলায় দ্রুত ও শক্তিশালী নীতিগত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
গত বছর চীনের রফতানি থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি উদ্বৃত্ত অর্জিত হয়েছে, যা অর্থনীতিকে কিছুটা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে। তবে, রিয়েল এস্টেট খাতের দীর্ঘমেয়াদি মন্দা এবং স্থবির অভ্যন্তরীণ চাহিদা পুনরুদ্ধারের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং সতর্ক করেছেন যে চীনের রফতানিকারকদের বড় ধরনের বহিঃস্থ পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি অভ্যন্তরীণ ভোক্তা ব্যয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে আগামী মাসগুলোতে রফতানি হ্রাস পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থনীতির অন্যান্য সূচকে মিশ্র চিত্র দেখা গেছে। খুচরা বিক্রয়ে মার্চ মাসে ৫.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৪ শতাংশ)। শিল্প উৎপাদনে ৭.৭ শতাংশ বৃদ্ধি (প্রথম দুই মাসে ছিল ৫.৯ শতাংশ)। রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগে প্রথম প্রান্তিকে ৯.৯ শতাংশ কমেছে।
তবে, যুব বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির চাপ (ডিফ্লেশন) অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এএনজেডের প্রধান চীন অর্থনীতিবিদ রেমন্ড ইয়াং বলেছেন, ভালো জিডিপি সংখ্যা পুরো অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে প্রতিফলিত করে না। ডিফ্লেশন ও যুব বেকারত্ব এখনও প্রধান উদ্বেগ।
চীনা নীতিনির্ধারকরা বারবার বলেছেন যে, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সংস্থান ও নীতি উপকরণ রয়েছে। গত বছর শেষের দিকে একাধিক আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে এবং আগামী মাসগুলোতে আরও সহায়তা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে, ফিচ সম্প্রতি চীনের সোভরেইন ক্রেডিট রেটিং কমিয়েছে সরকারি ঋণ ও রাজস্ব ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুল্কের ধাক্কা সামলাতে চীনকে সম্ভবত বড় আকারের রাজস্ব প্রণোদনার দিকে যেতে হবে।
ইউবিএসের পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৫ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি ৩.৪ শতাংশ হতে পারে। আগের পূর্বাভাস ছিল ৪ শতাংশ)। নোমুরা ও এএনজেড যথাক্রমে তাদের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ৪ শতাংশ ও ৪.২ শতাংশে এ নামিয়ে এনেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৮-এর বিশ্ব আর্থিক সংকট বা ২০২০-এর কোভিড-১৯ মহামারির মতোই এবার চীনকে একটি বড় ধাক্কা সামলাতে হবে। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে চীনের হাতে খুব বেশি বিকল্প নেই—তাদের এখন ভোক্তা ব্যয় বাড়ানো এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।