হ্যানয়ে শি জিনপিং

মার্কিন শুল্ক উত্তেজনার মধ্যে ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের চুক্তি

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক টানাপোড়েনের মধ্যেই ভিয়েতনামের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারে এগিয়েছে চীন। এই লক্ষ্যেই সোমবার ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে পৌঁছেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং। সফরের প্রথম দিনেই দু’দেশের মধ্যে একাধিক সহযোগিতা চুক্তি সই হয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।

চীনের রাষ্ট্রনেতা এই সফরকালে ভিয়েতনামের সঙ্গে উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘নহানদান’ পত্রিকায় এক নিবন্ধে সি লিখেছেন, ‘উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় আমাদের সহযোগিতা জোরদার করা উচিত।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘বাণিজ্য যুদ্ধ বা শুল্ক যুদ্ধের কোনও বিজয়ী থাকে না।’ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নাম তিনি উল্লেখ করেননি।

এ সফর ঘিরে দুই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তত ৪০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভিয়েতনামের উপ-প্রধানমন্ত্রী বোই থান সন। চুক্তিগুলোর বিস্তারিত প্রকাশ করা না হলেও এতে রেল যোগাযোগ, পরিবহন এবং বাণিজ্য সহযোগিতা সংক্রান্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। রবিবার একটি বাণিজ্যিক বিমান চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে ভিয়েতনাম বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের কিছু খাতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। চীন থেকে আমদানি করা পণ্যে ‘মেড ইন ভিয়েতনাম’ লেবেল বসিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ঠেকাতে দেশটি এ পদক্ষেপ নিয়েছে।

সোমবার সই হওয়া একটি সমঝোতায় চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রচার কাউন্সিল এবং ভিয়েতনাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই সংস্থা মূলত পণ্যের উৎপত্তি সনদ ইস্যু করে থাকে।

ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও অ্যাসেম্বলি কেন্দ্র। চীন থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে হ্যানয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি রফতানি করে। ভিয়েতনামের কাস্টমস তথ্যে দেখা গেছে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে তারা চীন থেকে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করেছে ৩১.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

সি জিনপিংয়ের এই সফর চীন-ভিয়েতনাম সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক। ভিয়েতনামের শীর্ষ নেতা তো লামের সঙ্গে সাক্ষাতের পর রেল যোগাযোগ খাতে চীনা ঋণে নতুন প্রকল্প গ্রহণে সম্মত হয়েছে হ্যানয়। যদিও এখন পর্যন্ত কোনও ঋণচুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি।

এদিকে চীনা তৈরি কমার্শিয়াল প্যাসেঞ্জার বিমান পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে ভিয়েতনাম। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমপর্যায়ে চীনের বিমান নিরাপত্তা সংস্থাকে স্বীকৃতি দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে হ্যানয়।

ভিয়েতনামের বাজেট এয়ারলাইন ভিয়েতজেট রবিবার একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। হ্যানয়ে সোমবার চেংদু এয়ারলাইন্সের লোগোসহ একটি চীনা বিমান পার্কিং অবস্থায় দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে দুইটি সি৯০৯ বিমান ভাড়া নিয়ে দুটি অভ্যন্তরীণ রুটে পরিচালনা করবে ভিয়েতজেট।

চীনের সঙ্গে ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হলেও দক্ষিণ চীন সাগরে সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা বেইজিংয়ের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। ভিয়েতনাম সম্প্রতি চীনা স্টিল পণ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে এবং ছোট মূল্যের চীনা পণ্যে কর ছাড় বাতিল করেছে।

এছাড়া ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট পরিষেবা অনুমোদনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রযুক্তিগত অংশীদারত্বও বাড়াচ্ছে ভিয়েতনাম। এই পদক্ষেপগুলো বেইজিংয়ের জন্য উদ্বেগজনক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সি জিনপিং হ্যানয় সফর শেষে মঙ্গলবার মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়া সফরে যাবেন। মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের মুখে পড়ায় এই দেশগুলোও ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা করছে শুল্ক থেকে রেহাইয়ের লক্ষ্যে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান টানাপোড়েনের মধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থান মজবুত করতে চাইছে চীন। আর সেই লক্ষ্যেই সি জিনপিংয়ের এই সফর, যেখানে ভিয়েতনামের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য, অবকাঠামো এবং প্রযুক্তি খাতে সম্পর্ক জোরদারের কৌশল নেওয়া হয়েছে। তবে দক্ষিণ চীন সাগরের নিরাপত্তা এবং ভিয়েতনামের যুক্তরাষ্ট্রঘেঁষা অবস্থান—এই দুই ইস্যুতে চীনের জন্য চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে।