শুল্কযুদ্ধে ট্রাম্পের দুর্বলতা ধরে ফেলেছেন শি জিনপিং?

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরই নিজেকে অনড় ও আত্মবিশ্বাসী নেতা হিসেবে তুলে ধরেছেন। বিশ্বজুড়ে শুল্কারোপ, শেয়ারবাজারের ধস বা লাখ কোটি ডলারের ক্ষতি—কোনও কিছুতেই তিনি দমে যাননি। বরং আমেরিকানদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘শান্ত থাকুন’। 

কিন্তু বুধবার হঠাৎ করেই তিনি পিছু হটলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ডের সুদের হার হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ও আর্থিক অস্থিরতার মুখে ৯০ দিনের জন্য কয়েক ডজন দেশের ওপর আরোপিত কিছু শুল্ক স্থগিত করলেন তিনি। এই সিদ্ধান্ত চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের জন্য এক প্রকার সুবিধাই এনে দিলো, যার সঙ্গে ট্রাম্প এক বিপজ্জনক ক্ষমতার খেলায় লিপ্ত ছিলেন। একে অনেকে বলছেন, বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বিভাজনের পথে এক বিপজ্জনক মোড়।

বিশ্লেষকদের মতে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এখন বুঝে গেছেন—এই খেলায় ট্রাম্পের ‘দুর্বল জায়গা’ কোথায়।

ট্রাম্প যতই বেপরোয়া ও উদ্ধত বলেই পরিচিত হন না কেন, চীনের নেতা শি জিনপিং সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠিত। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ শাসনব্যবস্থা, জাতীয় স্বার্থে জনদুর্ভোগকে গুরুত্বহীন বলে মনে করে। 

প্রবাসী চীনা ঔপন্যাসিক হাও কুন (ছদ্মনাম মু রং শ্যুয়েছুন) এক্সে লিখেছেন, শি জিনপিংয়ের আসল দুর্বলতা শুল্ক নয়। সাধারণ জনগণের দুঃখকষ্ট নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন নন।

গ্রাফিক্স: নিউ ইয়র্ক টাইমস

চীনা সংবাদমাধ্যমে সরাসরি কিছু জানা না গেলেও শির মানসিকতা বোঝা যায় তার অতীত ও শাসনকালের সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করে। 

তিনি নিজেই একসময় বলেছিলেন, আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সাত বছর কেটেছে লোয়েস মালভূমির এক গ্রামে কৃষিকাজ করে। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও কাজ শেষ করা সম্ভব। 

শি সব সময়ই কঠোরতার মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলেন। ২০২৩ সালে, যখন চীনের অর্থনীতি কোভিড-পরবর্তী দুর্বলতায় ভুগছিল এবং যুব বেকারত্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, “তরুণদের ‘তিতা খেতে শিখতে’ হবে।” 

একটি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে তার বক্তব্যে ‘কঠোরতা’ শব্দটি ৩৭ বার উল্লেখ করা হয়েছিল।

২০২২ সালে, যখন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল, তখনও চীন শির ‘জিরো কোভিড’ নীতিতে অনড় ছিল। কোটি কোটি মানুষ ঘরবন্দি, গণপরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইনে জীবন পার করেছে—অসংখ্য জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হয়েছে। শি তখনও পশ্চিমা টিকা আমদানিতে অনিচ্ছা দেখিয়েছেন।

চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে জাতীয়তাবাদী স্লোগান ও প্রচারণা এখন তুঙ্গে। অনেকেই মাও সেতুংয়ের কোরিয়ান যুদ্ধ নিয়ে মন্তব্যের ভিডিও শেয়ার করছেন। ওই মন্তব্যে মাও সেতুং বলেছিলেন, ‘তারা যত দিন লড়তে চায়, তত দিন লড়ব। সম্পূর্ণ বিজয় না হওয়া পর্যন্ত থামব না।’ 

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং ১৯৬৪ সালে মাওয়ের আরেকটি বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন—‘যুক্তরাষ্ট্র এক কাগুজে বাঘ। একবার খোঁচা দিলেই ফেটে যাবে।’ 

অনেকেই ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’-এর দৃষ্টান্ত টানছেন, যেখানে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত চীন বিজ্ঞান ও প্রকৃতির নিয়মকে অগ্রাহ্য করে হঠাৎ শিল্পায়নের চেষ্টা চালায়, যার ফলে দুর্ভিক্ষে কোটির ওপর মানুষ মারা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প যতই কঠোর হোন, তাকে বিনিয়োগকারী, শেয়ারবাজার ও ধনী উদ্যোক্তাদের চাপের মুখে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হয়। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ সমর্থক ইলন মাস্ক ও ধনকুবের উইলিয়াম অ্যাকম্যান পর্যন্ত তার শুল্কনীতি নিয়ে আপত্তি তোলেন। 

চীনে শি জিনপিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও বড় ব্যবসায়ী এমন অবস্থান নেন না। কেউ শুল্কের কারণে আয়ের ক্ষতি নিয়ে অনলাইনে কিছু লিখলেও তাকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। 

একজন ওয়েইবো ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘আমরা কোরিয়ার যুদ্ধে আমেরিকানদের তাড়িয়েছি, এবারও ভয়ের কিছু নেই। শুল্কের জবাব দিতে হবে লৌহমুষ্টিতে।’ মন্তব্যটি ৩ হাজার বারের বেশি পছন্দ করেছে মানুষ।

তবে শি জিনপিংয়েরও এক দুর্বলতা রয়েছে—সেটি হলো জনরোষ। ২০২২ সালের নভেম্বরে ‘জিরো কোভিড’ নীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিরল প্রতিবাদই নীতির অবসান ঘটায়। 

শুল্কের ফলে চীনের রফতানি, যা অর্থনীতির চালিকাশক্তি, বড় ধাক্কা খেতে পারে। তাই পরিস্থিতি চরমে গেলে হয়তো শিও কিছু ছাড় দেবেন। তবে সেটা জাতীয় স্বার্থে ‘কষ্ট সহ্য করার’ বার্তা দিয়েই হবে, সুবিধা নয়।

এই সংঘাতে শি জিনপিং জাতীয়তাবাদ, ইতিহাস ও ত্যাগের মন্ত্রে জনগণকে অনড় থাকতে বলছেন। আর ট্রাম্প অর্থনৈতিক চাপের মুখে কিছুটা নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছেন। এই মুহূর্তে বিশ্ব দেখছে, কে বেশি কষ্ট সহ্য করতে পারে—এটাই নির্ধারণ করবে বাণিজ্যযুদ্ধের ভবিষ্যৎ। 

যুক্তরাষ্ট্র যদি শেয়ারবাজার ও ধনীদের চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়, চীন হয়তো অপেক্ষা করে, ধৈর্যের শক্তিতে একধাপ এগিয়ে যাবে।

সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস