দুর্গাপুজোকে সামনে রেখে জোড়া আন্দোলনে বিদ্ধ হতে চলেছে তৃণমূল

জুনিয়র ডাক্তাররা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, আরজি কর ইস্যুতে তারা রাজপথ ছাড়ছেন না। তার ওপরে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো দুর্গাপুজোকে সামনে রেখে এবার জোড়া আন্দোলনে বিদ্ধ হতে চলেছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসবে অংশগ্রহণের আহ্বানকে ব্যর্থ করতেই পুজোর আবহের মধ্যে তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে রণনীতি সাজাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।

পুজোকে সামনে রেখেই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা ইতোমধ্যে দিয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। শুধু তাই নয়, পুজোর আবহকে কাজে লাগিয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানোর এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইছেন মুরলিধর সেন লেনের কর্তারা। তাই ছুটি না নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সব স্তরের নেতা-কর্মীদের।

ইতোমধ্যে ধর্মতলায় তিন পর্যায়ে ২৪ দিনের ধরণা শেষ হয়েছে। কিন্তু তিলোত্তমার ঘটনার সুবিচার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে গেরুয়া শিবির, তা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে বঙ্গ বিজেপি। এক মুহূর্তও বিরতি না নিয়ে বুধবারই কলকাতা, দমদম আর কাঁথিতে জোড়া মহামিছিলে হাঁটলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।

বঙ্গ বিজেপির নির্দেশে রাজ্যের সর্বত্র পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ড আর গ্রাম পঞ্চায়েতে দুই থেকে তিনটি করে পথসভা করবেন স্থানীয় নেতারা। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবরের মধ্যে এই কর্মসূচি পালন করা হবে। ওই সময় মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করবেন বিজেপিকর্মীরা রাজ্যজুড়ে। এরই মধ্যে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রতিটি থানায় ঝাঁটা আর গঙ্গাজল নিয়ে সাফাই অভিযান করবেন মহিলা মোর্চার সদস্যরা।

এখনই নবান্ন ঘেরাও না করে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করার পরিকল্পনা নিয়েছে গেরুয়া শিবির। ২৫ সেপ্টেম্বর ‘হাজরা চলো’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিজেপি। পুজোর দিনগুলোতেও আন্দোলন অব্যাহত রাখতে এবার বুকস্টলের সংখ্যা বাড়তে চলেছে বিজেপি। সেভাবেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রতিটি সাংগঠনিক জেলাকে। প্রতিটি অঞ্চলে যে পুজো মণ্ডপগুলোতে ব্যাপক জনসমাগম হয়, সেখানে বুকস্টল করবেন বিজেপি কর্মীরা।

এই বুকস্টল থেকেও তিলোত্তমার বিচারের দাবি ও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি থাকবে। বুকস্টল থেকে এই কর্মসূচিতে অংশ নেবেন সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিনহা প্রমুখ। গোটা রাজ্য থেকে এক কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তা রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের হাতে তুলে দেবেন তারা।

এদিকে, পুজোর আবহে কেন্দ্রীয় নেতাদের দিয়ে তৃণমূল-বিরোধী আন্দোলনের সুযোগ ছাড়তে নারাজ গেরুয়া শিবির। প্রতিবছরের মতো এবারও রাজ্যের পুজো উদ্বোধনে কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীদের আনতে দিল্লিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে আবেদন করেছে বঙ্গ বিজেপি। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কোনও নাম চূড়ান্ত না হলেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবারও পশ্চিমবঙ্গে পুজো উদ্বোধনে আসছেন, তা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। এমনটাই নয়াদিল্লি সূত্রে খবর।

তবে কোন কোন পুজো মণ্ডপ অমিত শাহ উদ্বোধন করবেন, তা এখনই প্রকাশ্যে আনতে চাইছে না গেরুয়া শিবির। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে রাজ্যজুড়ে যেভাবে সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যান করছে পুজো কমিটিগুলো, তাতে আশাবাদী বঙ্গ বিজেপি। তারা মনে করছে, রাজ্যের একটি বড় অংশের পুজো কমিটির রাশ তৃণমূলের হাত থেকে এবার চলে গেছে। তার ফলে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীদের দিয়ে গত বছরের চেয়ে বেশি পুজো উদ্বোধনে হাজির করানো সম্ভব হবে।

পুজোর দিনগুলোতে জনসংযোগ বাড়ানোর জন্য কমিটিগুলিতে স্থানীয় বিজেপি নেতা-কর্মীদের যুক্ত হতেও বলা হয়েছে। জানা গেছে, এবার বিজেপির তরফে কোনও পুজোর আয়োজনের সম্ভাবনা আপাতত নেই।

এদিকে, পুজোর আবহে আন্দোলনকে আরও তীব্র করার পরিকল্পনা করছে পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ। নবান্ন অভিযানে সাড়া পেয়েই তাদের এই সিদ্ধান্ত। এমনটাই জানা যাচ্ছে। যদিও নবান্ন অভিযানে অংশ নিয়ে এখনও জেলে রয়েছেন তাদের ৭ জন সাথী। বুধবার এ তথ্য জানিয়েছেন ছাত্র সমাজের প্রধান সমন্বয়ক সায়ন লাহিড়ী।

তিনি বলেন, ‘পুজোর আগেই যাতে তাদের জেল থেকে মুক্ত করা যায়, তা নিয়ে আমরা চেষ্টা করছি। তারা ফিরলেই পরবর্তী আন্দোলনের রূপরেখা প্রকাশ্যে আনব। আমরা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের পেজে ১১ দফা দাবি সামনে রেখে সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছি। গত তিন দিনে আমাদের অনলাইনে রাজ্যজুড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ সদস্য হওয়ার আবেদন করেছেন, যা আমাদের সাহস যোগাচ্ছে।’

ছাত্র সমাজের তরফে জানানো হয়েছে, এই মুহূর্তে জেলা ও ব্লক স্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সদস্য খুঁজছেন তারা। পাশাপাশি যারা সমাজের উন্নয়নে সামিল হতে চান, তাদেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জেলাভিত্তিক একজন করে সমন্বয়ক নিয়োগ করে তাদের দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

আগামী আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে সায়ন বলেন, ‘আমাদের একদফা এক দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ। উনি সরে গিয়ে তৃণমূল দলের যে কেউ মুখ্যমন্ত্রী হন, আমাদের বা রাজ্যবাসীর কোনও আপত্তি নেই। আমরা এরপর এমন আন্দোলন করব, যাতে কোনও ব্যারিকেডই আমাদের আটকাতে পারবে না। মানব সেতু তৈরি করে আমরা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাব। আর সেটা পুজোর আগেই করব। পুজোর সময় আমরা কলকাতাসহ রাজ্যের প্রতিটি জনবহুল পুজো মণ্ডপে আমাদের দিদির বিচারের দাবি ও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি প্রচার করব। আমাদের বন্ধুরা দর্শনার্থীদের কাছে দাবিগুলো তুলে ধরবেন। উৎসব নয়, এবার আমরা পুজোয় মায়ের কাছে বিচার চাইব দিদির জন্য, রাজ্যের মানুষের মুক্তির জন্য। শোককে ক্রোধে পরিণত করার শক্তি যেন মা আমাদের দেন, এটাই হবে আমাদের প্রার্থনা।’

এতদিন থিমের পুজো আর উৎসবের আনন্দে মেতে উঠা মহানগরী এবার তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে সত্যিকারের তিলোত্তমা কলকাতা হয়ে উঠবে কিনা, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরছে নগরবাসীর মনে।