বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিল্পীর সঙ্গে নৃত্যনাট্য করা ফরাসি অভিনেত্রী কানের মূল বিচারক

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের সঙ্গে সংলাপহীন নৃত্যনাট্য ‘ইন-আই’তে পারফর্ম করে নাচেও যে কম যান না দেখিয়ে দিয়েছিলেন অস্কারজয়ী ফরাসি অভিনেত্রী জুলিয়েট বিনোশ। ২০০৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনের লিটলটন থিয়েটারে এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়। এটাই ছিল জনসমক্ষে নৃত্যশিল্পী হিসেবে জুলিয়েট বিনোশের প্রথম পরিবেশনা। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে তাদের এই নৃত্যনাট্য। ২০০৯ সালের ১৮ অক্টোবর প্যারিসের থিয়েটার মারিনিতে ছিল এর শেষ মঞ্চায়ন।

নতুন খবর হলো, ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান বিচারক থাকবেন জুলিয়েট বিনোশ। ৬০ বছর বয়সী এই তারকা জুরি বোর্ডের সভাপতিত্ব করতে সম্মতি জানিয়েছেন। তার রায়েই স্বর্ণপাম জয়ী চলচ্চিত্র চূড়ান্ত হবে। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) আয়োজকরা এই তথ্য জানিয়েছে।

‘ইন-আই’ নৃত্যনাট্যে জুলিয়েট বিনোশ ও আকরাম খান (ছবি: ট্রিস্ট্যাম কেন্টন)

৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে বিচারকদের প্রধান ছিলেন ‘বার্বি’র পরিচালক গ্রেটা গারউইগ। আমেরিকান এই নির্মাতার স্থলাভিষিক্ত হলেন জুলিয়েট বিনোশ। কান উৎসবের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট একজন নারী অন্য নারীর রেখে যাওয়া মর্যাদাপূর্ণ মূল বিচারকের মশাল বহন করবেন। ১৯৬৫ সালে কানে ব্রিটিশ-আমেরিকান অভিনেত্রী অলিভিয়া ডি হাভিল্যান্ডের পর ১৯৬৬ সালে উৎসবটিতে বিচারকদের প্রধান ছিলেন ইতালিয়ান অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন। ছয় দশক পর ফের এমন উদাহরণ সৃষ্টি হলো।

৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের পর্দা উঠবে আগামী ১৩ মে। ভূমধ্যসাগরের তীরে দক্ষিণ ফরাসি উপকূলে এই মহাআয়োজন চলবে ২৪ মে পর্যন্ত।

১৯৮৫ সালে কানসৈকতে জুলিয়েট বিনোশ (ছবি: কান উৎসব)

কানসৈকতে ঠিক ৪০ বছর আগে প্রথমবার পা রেখেছিলেন জুলিয়েট বিনোশ। চার দশক পেরিয়ে প্রধান বিচারক হওয়ার অনুভূতিতে তিনি বলেন, ‘জুরি সদস্য ও দর্শকদের সঙ্গে জীবনের এসব অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ১৯৮৫ সালে প্রথমবার আর দশজন অল্পবয়সী অভিনেত্রীর মতোই উৎসাহ-উদ্দীপনা ও কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে উৎসবটির সিঁড়ি বেয়ে উঠেছিলাম। কখনও ভাবিনি ঠিক ৪০ বছর পর জুরি প্রেসিডেন্টের সম্মানজনক দায়িত্ব পাবো। এই সুযোগ, দায়িত্ব ও বিনয়ের জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’

১৯৮৫ সালে অঁন্দ্রে তেশিনে পরিচালিত ‘রদেভ্যুঁ’ ছিল জুলিয়েট বিনোশের প্রথম মূল চরিত্র। এটি ৩৮তম কান উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়। এজন্য তিনি প্রায়ই বলেন, ‘আমি কান উৎসবে জন্মগ্রহণ করেছি!’ একই বছর ৩৫তম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত জ্যঁ-লুক গদারের ‘হেইল ম্যারি’ ছবিতে দেখা গেছে তাকে।

২০১০ সালে কান উৎসবে সেরা অভিনেত্রী পুরস্কার জিতেছেন জুলিয়েট বিনোশ (ছবি: কান উৎসব)

২০১০ সালে আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘সার্টিফায়েড কপি’তে প্রাচীন জিনিসপত্রের ব্যবসায়ীর ভূমিকায় নৈপুণ্যের জন্য কানে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জয় করেন জুলিয়েট বিনোশ। উৎসবটির স্বর্ণপামের জন্য মনোনীত হয়েছে তার অভিনীত বেশ কিছু চলচ্চিত্র। এ তালিকায় রয়েছে দুইবার স্বর্ণপাম জয়ী অস্ট্রিয়ার মাইকেল হানেকে পরিচালিত ‘কোড আননোন’ (২০০০) ও ‘ক্যাশে’ (২০০৬), কানাডার ডেভিড ক্রনেনবার্গের ‘কসমোপলিস’ (২০১২), ফ্রান্সের অলিভিয়ের অ্যাসায়াস পরিচালিত ‘ক্লাউডস অব সিলস মারিয়া’ (২০১৪), ব্রুনো দুমোঁর ‘স্লেক বে’ (২০১৬), ফরাসি-ভিয়েতনামিজ নির্মাতা ট্র্যান আন হাং পরিচালিত ‘দ্য টেস্ট অব থিংস’ (২০২৩)। ২০০৭ সালে ৬০তম কানের আঁ সাঁর্তে রিগা বিভাগের উদ্বোধনী ছবি ছিল তাইওয়ানের হো সিয়াও সিয়েন পরিচালিত ও জুলিয়েট বিনোশ অভিনীত ‘ফ্লাইট অব দ্য রেড বেলুন’। এছাড়া কানের সমান্তরাল বিভাগ ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইটে তার ছবি নির্বাচিত হয়েছে একাধিকবার।

কান উৎসবে জুলিয়েট বিনোশ (ছবি: কান উৎসব)

জুলিয়েট বিনোশের ঝুলিতে নামিদামি সব পুরস্কারই আছে। পোল্যান্ডের ক্রিস্তফ কিসলোস্কি পরিচালিত ‘থ্রি কালারস: ব্লু’র জন্য ১৯৯৩ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ও ১৯৯৪ সালে সিজার অ্যাওয়ার্ডসে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন। অ্যান্থনি মিঙ্গেলার ‘দি ইংলিশ প্যাশেন্ট’ ছবিতে নার্সের ভূমিকায় হৃদয়ছোঁয়া অভিনয়ের সুবাদে ১৯৯৬ সালে অস্কার ও বাফটায় সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী এবং ১৯৯৭ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রী হন। ২০০০ সালে সুইডিশ নির্মাতা লাসে হালস্ট্রমের ‘চকোলেট’ ছবির সুবাদে অস্কার, বাফটা ও গোল্ডেন গ্লোবসে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।

ক্যারিয়ার জুড়ে নানান স্বাদের চলচ্চিত্রে বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক ও সমালোচক উভয় পক্ষের মন ছুঁয়েছেন জুলিয়েট বিনোশ। তার সহজাত প্রতিভার গুণমুগ্ধ হয়েছেন খ্যাতিমান নির্মাতারা। ফলে বিশ্বমানের কিছু কাজে সম্পৃক্ত হতে পেরেছেন তিনি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য– ফ্রান্সের লিওস কারাক্সের ‘দ্য নাইট ইজ ইয়াং’ (১৯৮৬, ৩৭তম বার্লিন), যুক্তরাষ্ট্রের আবেল ফেরেরা পরিচালিত ‘ম্যারি’ (২০০৫, ৬২তম ভেনিস), বেলজিয়ামের শান্টেল অ্যাকারম্যান পরিচালিত ‘অ্যা কাউচ ইন নিউইয়র্ক’ (১৯৯৬), অঁন্দ্রে তেশিনের ‘অ্যালিস অ্যান্ড মার্টিন’ (১৯৯৮), আর্জেন্টিনার সান্তিয়াগো আমিগোরেনা পরিচালিত ‘অ্যা ফিউ ডেজ ইন সেপেটম্বর’ (২০০৬, ৬৩তম ভেনিস), অ্যান্থনি মিঙ্গেলার ‘ব্রেকিং অ্যান্ড এন্টারিং’ (২০০৬), ইসরায়েলের আমোস গিতাই পরিচালিত ‘ডিসএনগেজমেন্ট’ (২০০৭, ৬৪তম ভেনিস), ব্রুনো দুমোঁর ‘কামিল ক্লদেল ১৯১৫’ (২০১৩, ৬৩তম বার্লিন), স্পেনের ইসাবেল কোয়শেত পরিচালিত ‘এন্ডলেস নাইট’ (২০১৫, ৬৫তম বার্লিন), ইতালির পিয়েরো মেসিনা পরিচালিত ‘দ্য ওয়েট’ (২০১৫, ৭২তম ভেনিস), ফ্রান্সের ক্লেয়ার দঁনির ‘লেট দ্য সানশাইন ইন’ (২০১৭), ‘হাই লাইফ’ (২০১৮) ও ‘বোথ সাইডস অব দ্য ব্লেড’ (২০২২, ৭২তম বার্লিন), জাপানের নাওমি কাওয়াসের ‘ভিশন’ (২০১৮), অলিভিয়ের অ্যাসায়াসের ‘নন-ফিকশন’ (২০১৮, ৭৫তম ভেনিস), স্বর্ণপাম জয়ী জাপানের হিরোকাজু কোরে-এদার ‘দ্য ট্রুথ’ (২০১৯, ৭৬তম ভেনিস), ইতালির উবের্তো পাসোলিনির ‘দ্য রিটার্ন’ (২০২৪, টরন্টো উৎসব)।

জুলিয়েট বিনোশ (ছবি: কান উৎসব)

ছোট পর্দায় গত বছর অ্যাপল টিভি প্লাসের ‘দ্য নিউ লুক’ সিরিজে বিখ্যাত ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার কোকো শানেল চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন জুলিয়েট বিনোশ। এইচবিও ম্যাক্সের মিনি সিরিজ ‘দ্য স্টেয়ারকেস’ তার আরেকটি আলোচিত কাজ।

মঞ্চনাটকেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন জুলিয়েট বিনোশ। সাহিত্যে নোবেল জয়ী প্রয়াত ইতালিয়ান নাট্যকার লুইজি পিরান্দেলোর ‘ন্যাকেড’ ১৯৯৮ সালে লন্ডনে ও সাহিত্যে নোবেল জয়ী হ্যারল্ড পিন্টারের ‘বিট্রায়াল’ ২০০০ সালে নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতে তার অভিনীত অন্যতম দুটি প্রযোজনা। এছাড়া তিনি গান করেন ও ছবি আঁকেন।

কান উৎসবে জুলিয়েট বিনোশ (ছবি: কান উৎসব)

শুধু অভিনয় কিংবা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নয়, বিশ্ব পরিবেশের জন্য হুমকি প্রসঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিয়মিতভাবে ভূমিকা রাখেন জুলিয়েট বিনোশ। ইরানি নির্মাতা জাফর পানাহির কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে কান উৎসবে প্রতিবাদ জানাতে মঞ্চে তার নাম লেখা একটি প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে ধরেছিলেন। মিটু হ্যাশট্যাগ আন্দোলনের অপরিহার্য প্রেক্ষাপটে একাত্মতা প্রকাশ করেন। শিক্ষা, অভিবাসন কিংবা মানবাধিকার নিয়ে নিয়মিত সোচ্চার ভূমিকা রাখতে দেখা যায় তাকে। সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ফিল্ম অ্যাকাডেমির নতুন সভাপতি হয়েছেন তিনি।