সপ্তাহে দু’দিন করে প্রায় ছয়মাস টানা মহড়া হলো টরন্টোয়। উদ্যোগে নাট্যসংঘ কানাডা। যাদের ডাকে মহড়ায় যোগ দিয়েছে একঝাঁক উদ্যমী নাটক-অন্তঃপ্রাণ প্রতিভাবান। সম্মিলিত প্রয়াসে সম্প্রতি একই মঞ্চে পরপর দু’দিন নাটকের মঞ্চায়ন হলো সফলভাবে। নাটক দুটির নাম ‘পৌরাণিক’ এবং ‘রামগরুড়ের ছানা’।
টরন্টোতে নাট্যসংঘ কানাডার এটা তৃতীয় আয়োজন। নাট্যকার-নির্দেশক সুব্রত পুরুর কথা থেকে, পাটিগণিতের ঐকিক নিয়মে পারদর্শী না হয়েও, সহজে আমরা অনুমান করতে পারি প্রবাসের শশব্যস্ত জীবনে নাটক মঞ্চায়নের মতো কঠিন এবং কষ্টসাধ্য কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে কলাকুশলীদের যৌথভাবে মোট কয় হাজার কর্মঘণ্টা এবং কি পরিমাণ শ্রম ব্যয় করতে হয়েছে এবং সেই সাথে মোকাবেলা করতে হয়েছে কতো প্রতিকূল অবস্থা।
দু'টো নাটকেরই নাট্যকার এবং নির্দেশক সুব্রত পুরু। স্বরচিত নাটকের নির্দেশনায় একদিকে যেমন অতিরিক্ত চাপে বস্তুনিষ্ঠতা কিছুটা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, অন্যদিকে নিজের সৃষ্টিশীল স্বাধীনতায় নাট্যকার নাটকের কাহিনী, চরিত্র ও সংলাপের সাথে সঙ্গতি রেখে নাটকের মূল প্রতিপাদ্য দর্শকের সামনে তুলে ধরতে সঠিক নির্দেশনাটি বেছে নিতে পারেন। এতে নাট্যকারের স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্দেশ্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়, যা নাটকের সামগ্রিক সাফল্যে অবদান রাখে।
‘পৌরাণিক’ নামের মধ্যেই এক চিরায়ত সময়ের গন্ধ পাওয়া যায়। নাটকটির প্লট বিনির্মাণে গ্রীকপুরাণের কিউপিড-সাইকি উপাখ্যান এবং ময়মনসিংহ গীতিকার নদের চাঁদ-মহুয়ার প্রেমগাঁথার মধ্যে সার্থক সেতুবন্ধন রচনা করে নারী-পুরুষের ভালোবাসার চিরন্তন ঘটনাকে নির্দেশক সুব্রত পুরু হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরেছেন।
‘পৌরাণিক’ শ্রুতি-মঞ্চ নাটক। নাম থেকেই বোঝা যায় শ্রুতির সাথে শ্রবণেন্দ্রিয়ের একটা সম্পর্ক আছে। এখানে কণ্ঠ অভিব্যক্তির নাটকীয় ব্যবহারে পাত্র-পাত্রী নাটকের দৃশ্যকল্প মঞ্চে ফুটিয়ে তোলেন। তাই দৃশ্যকাব্য ও শব্দকাব্যের সমন্বিত উপস্থাপনা এবং সংগীত ও নৃত্যের সুষম সংযোজনার ওপর শ্রুতি-মঞ্চ-নাটকের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভরশীল।
নাটকের পরের পর্বে দৃশ্যায়িত হয় যথাক্রমে কিউপিড-সাইকি এবং নদের চাঁদ-মহুয়ার ভালোবাসার উপাখ্যান দু’টি। এতে হরকি, সাইকি এবং মাথিন এই তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন এলিনা মিতা, আর কিউপিড এবং নদের চাঁদের দ্বৈত ভূমিকায় মঞ্চে আসেন তাপস দেব। চরিত্র দু’টিকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় তাপস দেব অনেকাংশে সফল হয়েছেন। নৃত্যরত সাইকি হঠাৎ মঞ্চে দেখতে পায় কিউপিডকে। সে এসেছে মায়ের নির্দেশে সাইকিকে নিকৃষ্টের প্রেমে জড়াতে। কিন্তু প্রেমতো নিষেধ মানে না। উল্টো, মায়ের কড়া নির্দেশ বেমালুম ভুলে গিয়ে কিউপিড আত্মহারা সাইকির প্রেমে। এতে মায়ের আজ্ঞা পালনে কিউপিড এর ব্যর্থতাজনিত অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং ক্রাইসিসকে অভিনয়ের মাধ্যমে আরও দর্শক মনোগ্রাহী করে তোলার সম্ভাবনা ছিলো। একইভাবে নদের চাঁদের ভূমিকায় সংলাপে এবং দেহভঙ্গিমায় কিছুটা বাড়তি মাত্রা যুক্ত হলে চরিত্রটি আরও পূর্ণতা পেতো বলে আমার বিশ্বাস।
প্রশ্ন জাগে মনে, নাটক শুধু কি বিনোদন মাধ্যম? না, বিনোদনের পাশাপাশি নাটকে থাকে সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলন। আয়নায় দেখা যায় আমাদের অবয়ব। তেমনি নাটকে ফুটে ওঠে আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। এজন্যে নাটক সমাজের মুকুর। নাট্যের কলাকুশলীগণ তাদের অভিনয়শৈলী, মঞ্চসজ্জা, আলোকসম্পাত ও শব্দ-নিয়ন্ত্রণ দক্ষতায় নাটকে বর্ণিত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার মুহূর্তগুলো দর্শকের সামনে জীবন্ত করে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
একই মঞ্চে মঞ্চায়িত দ্বিতীয় নাটক ‘রামগরুড়ের ছানা’। স্যাটায়ার ঘরানার এই নাটকের পটভূমি টরন্টোর ‘বাংলাদেশি ডায়াস্পোরা’। উন্নত জীবন যাপনের প্রত্যাশায়, পরিচিত পরিবেশ-পরিজন ছেড়ে আসা অভিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় প্রত্যেককেই নতুন পরিবেশে নতুন করে শুরু করতে হয় জীবন সংগ্রাম। মোকাবিলা করতে হয় নানা চ্যালেঞ্জ। নিজের যোগ্যতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ, স্ব-স্ব পেশায় চাকুরী পাওয়ার চ্যালেঞ্জ এবং বহুভাষী সমাজে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ। এটা সত্য যে ‘হাইস্কিল্ড ইমিগ্রেশন ক্যাটেগরিতে নির্বাচিত হয়ে পি আর নিয়ে কানাডায় আসার পরও বেশির ভাগ অভিবাসীদের নিজ পেশায় চাকরি পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই প্রবাসে টিকে থাকার প্রয়োজনে তাদের বেছে নিতে হয় বিকল্প জীবিকা বা ‘সেকেন্ড ক্যারিয়ার’।
অভিবাসী জীবনের কঠিন বাস্তবতায় মানুষ ভুলে যেতে পারে সবকিছু, কিন্তু ভুলতে পারে না তার সংস্কৃতি। যার সাথে রয়েছে তার শেকড়ের সংযোগ। তাই একটু থিতু হলেই তারা মেতে ওঠে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, গড়ে তোলে নানান সংগঠন এবং আয়োজন করেন নাচ, গান, আবৃত্তি অনুষ্ঠান ও লোক-মেলা। পাশাপাশি আয়োজিত হয় ঘরোয়া আড্ডায় যেখানে অভিবাসী সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ মেতে ওঠে ‘পপুলার গসিপ’-এ। যার মূল বিষয়বস্তু দেশীয় রাজনীতি, সংস্কৃতি, পরস্পরের পিঠ-চাপড়ানি, সেই সাথে ‘পি-এন’ এবং ‘পি-সি’ যার অর্থ পরনিন্দা ও পরচর্চা।
‘রামগরুড়ের ছানা’ নাটকের প্রথম দৃশ্য একটি ঘরোয়া আড্ডা। ‘পপস’হীন সাদামাটা মঞ্চ। পর্দা উঠতেই গানের ছন্দে-সুরে নানা অঙ্গ ভঙ্গিমায় দর্শকদের সাথে ভাব বিনিময় করতে করতে কুশীলবদের মঞ্চে প্রবেশ একটা হালকা হাসির আমেজ সৃষ্টি করে, যা নাটকের শিরোনামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। ঘরোয়া আড্ডায় উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে আছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, আবৃত্তিকার আর নতুন ইমিগ্র্যান্ট। চরিত্রগুলোর সংলাপের মাধ্যমে নির্দেশক সুব্রত পুরু টরন্টোর ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশি অভিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পেশাগত কর্মকাণ্ডের এক বাস্তব চিত্র হাস্যরসের মাধ্যমে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছেন।
ঘরোয়া আড্ডায় মঞ্চের এক পাশে পুরুষেরা আলাপে ব্যস্ত; অন্যপাশে মহিলারা। কখনও পুরুষদের দিকে আলোকসম্পাত, পরক্ষণে তা মহিলাদের দিকে। প্রয়োজন অনুযায়ী উভয় দিকে আলো-ছায়া দিয়ে এমন মোহময় পরিস্থিতির উপস্থাপনা সহজেই হলভর্তি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
মঞ্চ-নাটকের সাফল্য, আমরা জানি, বহুলাংশে অভিনয়-দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। নাট্যের কুশীলবগণ অভিনয় নৈপুণ্যে নাটকে প্রাণসঞ্চার করেন। দর্শক যখন মঞ্চের চরিত্রগুলোর হাসি-কান্নায়, আনন্দ-বেদনায়, আবেগ-উৎকণ্ঠায় একাত্ম হয়ে পড়েন, নাটক তখনই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। বললে অত্যুক্তি হবে না ‘রামগরুড়ের ছানা’ নাটকে অভিনেতা-অভিনেত্রী সকলেই তাদের অভিব্যক্তি, দেহভঙ্গিমা এবং স্বরক্ষেপণের ওঠা-নামায় দর্শকদের সম্পৃক্ত করতে সচেষ্ট ছিলেন।
বাবার ভূমিকায় মাহমুদুল ইসলাম সেলিম চরিত্রের গভীরে ঢুকে গিয়ে নজরকাড়া অভিনয় করেছেন। তবে শেষ দৃশ্যে মেয়ের ডাক্তার হওয়ার সংবাদে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নে তার হৃদয়ের পুঞ্জিভূত আনন্দের বহিঃপ্রকাশ আরও কিছুটা জোরালো এবং আবেগাপ্লুত হলে দর্শক সংলগ্নতা বেড়ে যেত বলে আমার বিশ্বাস। রহিমের চরিত্রে অনুপ সেনগুপ্ত সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে হলভর্তি দর্শকের মন জয় করেছেন। জয়ের ভূমিকায় ম্যাক আজাদ প্রলম্বিত সংলাপে জমিয়ে অভিনয় করে দর্শকদের হাস্যরসে ভরিয়ে তুলেছেন। ভালো লেগেছে ব্যারিস্টার প্রহর হিল্লোলের চরিত্রে মৃণাল বন্দ্যর অভিনয়। ঠিক ততোটাই সমুজ্জ্বল আরেফ কাজীর ভূমিকায় অমিত গোমেজ। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আহ্লাদ উদ্দিনের ভূমিকায় চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে চমৎকার অভিনয় করেছেন সুভাষ দাশ। টরন্টোর আবৃত্তিকার বৃত্যাংশু হিতাকাঙ্খীর চরিত্রে আশরাফ রানার যুতসই অভিনয় দর্শকদের প্রচুর আনন্দ দিয়েছে। মায়ের ভূমিকায় ইশরাত দীপ্তি চমৎকার অভিনয় করে দর্শকদের নজর কেড়েছেন। প্রথম নারীর ভূমিকায় অনিন্দিতা বিশ্বাসের অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। নাহিদ আশরাফি দ্বিতীয় নারীর ভূমিকায় প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন। তবে মাঝে মাঝে তার অভিনয় কিছুটা অতিনাটকীয় মনে হয়েছে। হেল্পডেস্ক পার্সন এবং উপস্থাপিকার চরিত্রে জুসী ডায়না বিশ্বাস দারুণ অভিনয় করেছেন। কফিশপ সেলসপার্সন এর ভূমিকায় নবনী তাহসিন ও সুকন্যা দাশের স্বচ্ছন্দ অভিনয় দর্শকনন্দিত হয়েছে।
লেখক: প্রফেসর, জর্জ ব্রাউন কলেজ, কানাডা