ঠিক নির্মাতা বলা যাবে না। তারা তো মূলত সিনেমা-শ্রমিক। কারণ, একটি সিনেমার প্লট মাথায় নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেটির প্রযোজক জোগাড়, লোকেশন বাছাই, কাস্টিং, শুটিং, সম্পাদনা, মিউজিক থেকে শুরু করে মুক্তির পরেও হলে হলে ঘুরে বেড়ানো এবং মিডিয়ার কাছে সব জবাবদিহি একজন মানুষই মূলত শ্রমিকের মতো উদয়-অস্ত করে বেড়ান; তিনি বাংলাদেশের সিনেমা নির্মাতা।
প্রচলিত আছে, এই দেশে একজন নির্মাতা একটি সিনেমা বানানো মানে তার জীবন থেকে অর্ধেক আয়ু ক্ষয় করে ফেলা! আর সেটি প্রদর্শনের জন্য সঠিক হল বা শো না পাওয়া মানে অকাল মৃত্যুবরণ করা। এমন পরিস্থিতিতে মহান মে দিবসে (১ মে) যেন নতুন করে গর্জে উঠলেন সিনেমার সেই অকৃত্রিম শ্রমিকরা। যাদের মুখে হাসি ফুটেছিল গত ঈদে। ১১টি ছবির মধ্যে অন্তত ৫ ছবির ফলাফল বেশ ভালো। ঈদের তিন সপ্তাহ পরেও যে হাসির রেশ এখনও স্পষ্ট মাল্টিপ্লেক্সের সিট প্ল্যানে।
এমন সময়ে গত ঈদের অন্যতম সফল তিন সিনেমার (রাজকুমার, দেয়ালের দেশ ও কাজলরেখা) নির্মাতার পক্ষ থেকে উঠেছে কারণ ছাড়াই ‘হাউজফুল’ ছবি নামিয়ে দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ। তাদের আলাদা আলাদা প্রতিক্রিয়ায় একটাই অভিযোগ, ৩ মে থেকে দেশের সবচেয়ে বড় মাল্টিপ্লেক্স চেইন স্টার সিনেপ্লেক্স ঈদের সব সিনেমা নামিয়ে দিচ্ছে তাদের শো-শিডিউল থেকে। বিনিময়ে তুলছে বিদেশি ছবি। প্রমাণপত্র হিসেবে প্রত্যেকেই দিয়েছেন ১ মে’র অনলাইন টিকিটের প্রায় ‘হাউজফুল’ স্ক্রিনশট।
আগামী শুক্রবার (৩ মে) থেকে বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্সে ৬টা বিদেশি সিনেমা চলবে, যেখানে বাংলা সিনেমা চলবে একটা। ১৬টি শো বিদেশি সিনেমার, ৪টা শো বাংলা সিনেমার! বাংলাদেশের সিনেমা হল, বাংলাদেশের মানুষই দর্শক, বাংলা সিনেমার দর্শক থাকার পরেও বাংলা সিনেমা নাই! এই দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াতে অনেক পথ বাকি, অনেক...।’’
একইভাবে নিজ নিজ ছবির আজকের (১ মে) টিকিট বিক্রির উদাহরণ টেনে কাছাকাছি প্রতিক্রিয়া বা হতাশা ব্যক্ত করেছেন ‘কাজলরেখা’র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম এবং ‘দেয়ালের দেশ’ নির্মাতা মিশুক মনি।
ঈদের তিন সপ্তাহের মাথায় তিন সফল নির্মাতার এমন জোটবদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় অনেকটাই থমকে গেছে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বাংলা সিনেমার দর্শকরা। বিপরীতে এটাও তো প্রশ্ন, কেন স্টার সিনেপ্লেক্স ‘হাউজফুল’ বাংলা সিনেমাকে ফেলে বিদেশের ছবি তুলবে! তাও আবার এর মধ্যে মুক্তি পাওয়া বিদেশি ছবিগুলোও পায়নি দর্শকপ্রিয়তা। ২৬ এপ্রিল স্টার সিনেপ্লেক্স মুক্তি দিয়েছিল তুমুল আলোচিত স্প্যানিশ ভাষায় নির্মিত আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয়ের ডকুফিল্ম ‘মুচাচোস’। সেটি এর মধ্যে পায়নি দর্শক। আজ (১ মে) মাল্টিপ্লেক্সটি মুক্তি দিয়েছে হলিউডের আলোচিত নতুন ছবি ‘দ্য ফল গাই’। প্রথম দিনেই এটির টিকিট কাটতি হতাশাজনক। তাহলে কী কারণে স্টার সিনেপ্লেক্স ‘প্রায় হাউজফুল’ বাংলাদেশি ছবিগুলো নামিয়ে দিচ্ছে?
কিন্তু আবেগে তো আর ইন্ডাস্ট্রি চলে না। টানা তিন সপ্তাহ কেন, ছয় সপ্তাহ চালানোর পরেও যদি কোনও সিনেমার দর্শক থাকে, সেটি নামিয়ে দিলে আপত্তি বা অভিযোগ উঠবেই। সেই অভিযোগটাই তুলেছেন নির্মাতারা। কেন নামাতে হচ্ছে ছবিগুলো?
স্টার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনও পুরো উত্তর মেলেনি। কারণ, নির্মাতারা প্রমাণসহ অভিযোগ তুলেছেন। দেখিয়েছেন, আজও (১ মে) তাদের সিনেমাগুলোর শো প্রায় ‘হাউজফুল’। তবু কেন চতুর্থ সপ্তাহের মাথায় নামাতে হবে ছবিগুলো?
স্টার কর্তৃপক্ষ এটুকু নিশ্চিত করেছে, সিনেমা নামিয়ে ফেলা চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নয়। এই ছবিগুলো তারা সময়ের মাপে ঠিকই নামাবেন, তুলবেন, শো কমাবেন বা বাড়াবেন। সেটাই আসলে তাদের কাজ। বিপরীতে কোনও নির্মাতাই চায় না তার ছবিটা নামুক।
এদিকে ‘কাজলরেখা’ নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের আহ্বান, ‘‘বসুন্ধরায় আজকের ৪টা ৩০-এর শো হাউজফুল। তারপরও আগামী শুক্রবার থেকে বিদেশি ছবির জন্য ‘কাজলরেখা’র কোনও শো নাই। কেন? ঈদের অন্য সিনেমাগুলোও নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্তত ৪০% শো বরাদ্দ দেশি সিনেমার জন্য রাখার অনুরোধ করছি।’’
সেলিমের অনুরোধ যৌক্তিক। তবে তথ্যে খানিক বিভ্রাট আছে। আসছে সপ্তাহে বিদেশি ছবির সঙ্গে দুটো নতুন বাংলা সিনেমাও যুক্ত হচ্ছে, জানিয়েছে স্টার কর্তৃপক্ষ।
এদিকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিন নির্মাতার এই প্রতিবাদে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল হ্যান্ডেলে। ফুঁসে উঠেছে সিনেমা-শ্রমিক সমাজ। ফলে স্টার কর্তৃপক্ষ নতুন করে ভাবতেও পারে, ঈদের ছবিগুলো পর্দায় বহাল রাখার নিমিত্তে।