সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে ছয় হাজার ৫৩১ জনকে সুপারিশ করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে আদালতে নিয়োগ বাতিলের রিট করেন সুপারিশ না পাওয়া ৩১ জন। আদালতের আদেশে আটকে যায় সুপারিশপ্রাপ্তদের চাকরি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় আন্দোলন।
শনিবার (১ মার্চ) ২৪তম দিনের আন্দোলনে কাফনের কাপড় পরে নিয়োগপ্রত্যাশীরা প্রতীকী ফাঁসির আয়োজন করেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। আজ রবিবার (২ মার্চ) উচ্চ আদালতে মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আদালতের আদেশের ওপর নির্ভর করছে তাদের চাকরি। রায়ের দিন নিয়োগপ্রত্যাশীরা ২৫তম দিনের আন্দোলনে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন।
নিয়োগপ্রত্যাশীরা বলছেন, ‘সরকার চাইলে রবিবার আন্দোলন শেষ হবে। কারণ সরকার যদি চায় আদালতের রায় আমাদের পক্ষে আসবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া বৈধ, আর নিয়োগ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। তাই সরকার চাইলেই আদালতের রায় আমাদের পক্ষে আসবে, না চাইলে হবে না।’
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে চূড়ান্ত নিয়োগ কার্যক্রম এবং অপেক্ষমাণ তালিকা থেকেও নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। বাকি থাকে তৃতীয় ধাপের ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রার্থীদের নিয়োগ। ২০২৩ সালের ১৪ জুন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের ২১টি জেলার প্রার্থীদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০২৪ সালের ২৯ মার্চ। ফল প্রকাশ করা হয় ২১ এপ্রিল। লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয় ১২ জুন। যেহেতু নিয়োগটি ২০২৩ সালের, তাই প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মতো তৃতীয় ধাপের ফল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৩১ অক্টোবর প্রকাশ করে। এতে ছয় হাজার ৫৩১ জন চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পান।
রিট আবেদনে আটকে যায় নিয়োগ
প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ৩১ জন চূড়ান্ত ফলাফলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছয় হাজার ৫৩১ জনের নিয়োগ কার্যক্রম ছয় মাসের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।
বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি
নিয়োগ স্থগিত হওয়ার কারণে সুপারিশপ্রাপ্ত নিয়োগপ্রত্যাশীরা গত ১৪ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন করেন। ওইদিন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার তাদের পাঁচ জনের প্রতিনিধির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে কথা বলেন। সুপারিশপ্রাপ্তদের সব আইনি নিয়ম মেনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, একজনও বাদ যাবেন না এবং হাইকোর্টের দ্রুত আইনি জটিলতা শেষ করে দ্রুত যোগদানের ব্যবস্থা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন উপদেষ্টা।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতির পর চেম্বার জজ আদালত, আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্টে ৭টি শুনানির পর চূড়ান্ত রায়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পরীক্ষার ফল বাতিল করেন। ওইদিন এই রায় জানার পর থেকেই নিয়োগপ্রত্যাশীরা লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দেন। আন্দোলন চলাকালে একাধিক দিন নিয়োগপ্রত্যাশীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, আটক, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করা হয়। কিন্তু নিয়োগপ্রত্যাশীরা আন্দোলন বন্ধ করেননি। লাগাতার আন্দোলন করে যাচ্ছেন এখনও।
‘সরকার চাইলে ররিবারই আন্দোলন শেষ হবে’
শনিবার (২ মার্চ) শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আন্দোলন শেষে বিকালে কাফনের কাপড় পরে শহীদ মিনারে গিয়ে প্রতীকী ফাঁসির আয়োজন করেন তারা। সন্ধ্যার আগে শহীদ মিনার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থান নেন শিক্ষকরা। দিনভর লাগাতার আন্দোলনের সময় শিক্ষকরা রাতে রাস্তায় কিংবা যেখানে থাকা যায় বিভিন্নভাবে থেকে দিনে আন্দোলন করতেন। শনিবার (১ মার্চ) রাতে টিএসসিতে রাত কাটিয়ে আবার রবিবার (২ মার্চ) অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন নিয়োগপ্রত্যাশীরা।
সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত এক শিক্ষক বলেন, ‘আদালতের রায় আমাদের পক্ষেই আসবে। কারণ সরকার আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নিয়োগপ্রত্যাশী বলেন, ‘সরকার যেমন চাইবে রায়, তেমনই আসবে। আশা করি, সরকার আমাদের পক্ষে থাকবে।’
সুপারিশপ্রাপ্ত আন্দোলনরত অন্য নিয়োগপ্রত্যাশীরাও জানান সরকার চাইলেই রবিবার আন্দোলন শেষ হবে। আমরা সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
নিয়োগ সুপারিশ পেয়ে চাকরি ছেড়েছেন তারা
২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ২০২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর জেলা শিক্ষা অফিস এবং ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর স্কুলে পদায়ন সম্পর্কিত নিয়োগ আদেশ জারি করা হয়। সুপারিশপ্রাপ্তরা নিজ নিজ জেলা সিভিল সার্জনের কার্যলয়ে মেডিক্যাল টেস্ট এবং জেলা শিক্ষা অফিসে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য কাগজ জমা দেন। সব জেলার প্রায় সব উপজেলার চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্তরা যোগদানপত্রও হাতে পেয়েছেন, শুধু স্কুলে পদায়ন বাকি ছিল। নিয়োগের সুপারিশ পাওয়ার পর যারা বিভিন্ন চাকরিতে ছিলেন তারা চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু সুপারিশ পাওয়ার পরও এখন চাকরির অনিশ্চয়তায় দিশেহারা ছয় হাজার ৫৩১টি পরিবার।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য
শিক্ষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত মো. মহিব বুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাধীন দেশে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আন্দোলনে পুলিশের অমানবিক টিয়ারশেল নিক্ষেপ, লাঠিপেটা, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারে শতাধিক শিক্ষক আহত হয়েছেন। গর্ভবতী ও কোমলমতি ছোট বাচ্চারাও পুলিশের অমানবিক নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি। তবু আশা রাখি সরকার আমাদের পক্ষে থাকবে। সরকার পক্ষে থাকলেই রায় আমাদের পক্ষে আসবে।’
তিনি আরও জানান, শনিবার দিনগত রাতে তারা শাহবাগে থাকবেন। সকালে অবস্থান কর্মসূচি চলমান থাকবে। আদালতের রায় পক্ষে আসার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন প্রত্যাহার করে ঘরে ফিরবেন।
নিয়োগপ্রত্যাশীদের প্রতিনিধি জান্নাতুল নাঈম সুইটি বলেন, ‘আদালতের রায়ে আমাদের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এই রায় যদি বাতিল করা না হয়, রাষ্ট্র যদি এই রায় বাতিলের ব্যবস্থা না করে তাহলে এই আন্দোলন আরও কঠিন হবে। আমরা আমাদের অধিকার ফিরে পেতে চাই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের যোগদান নিশ্চিত না করতে পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত রাজপথ ত্যাগ করবো না।’
সুপারিশপ্রাপ্ত নওরীন চাঁদনী, তালুকদার পিয়াসও জানিয়েছেন নিয়োগ না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা।