দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে ‘বঞ্চনা’র শিকার বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষক। তাদের দাবি, এই দীর্ঘ সময়ে রাজপথে অনেক আন্দোলন করেছেন, পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর তারা মনে করেছিলেন, এবার হয়তো বঞ্চনার নিরসন হতে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা হয়নি। তবে এখন আর আন্দোলন করতে চান না এই শিক্ষকরা। দীর্ঘদিনের সংকট নিরসনে এমপিওভুক্তির জন্য ‘আশ্বাসে’ আস্থা রেখে অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। প্রতি বছর শিক্ষার বাজেট থেকে যে পরিমাণ অর্থ ফেরত যায়, তা দিয়ে এমপিওভুক্তি করা হবে– এমনটাই প্রত্যাশা শিক্ষকদের।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি এবং ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাই’ শিরোনামে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের কর্মসূচিসহ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেন এমপিও-প্রত্যাশী শিক্ষকরা। তবে অর্থ বিভাগের সম্মতি না থাকায় সেই যাত্রায় ব্যর্থ হন তারা।
শিক্ষকরা বলছেন, বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচির পর বিগত আওয়ামী লীগের আমলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের এমপিওভুক্তির জন্য অর্থ বিভাগের মতামত চায়। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে পদ না থাকায় এমপিওভুক্তির বিষয়টি নাকচ করে অর্থ বিভাগ।
এরপর শিক্ষকরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সামনে এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দফায় দফায় আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের জানায়, অর্থ বিভাগ নাকচ করার কারণে তারা এমপিওভুক্ত করতে পারছে না। তবে অর্থ বিভাগের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সুরাহা করা হবে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৫ অক্টোবর বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সামনে ফের অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশনের ব্যানারে লাগাতার কর্মসূচির তৃতীয় দিন রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করতে থাকেন শিক্ষকরা। অবরোধ চলাকালে ১৭ অক্টোবর পুলিশের লাঠিপেটার কারণে তারা রাস্তা থেকে সরে যান।
বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি নেকবর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আর আন্দোলন নয়, আমরা অপেক্ষা করছি। শিক্ষকরা অপেক্ষা করছেন শিগগিরই যাতে এমপিওভুক্ত করা হয়। আমরা চলতি অর্থবছরেই এমপিওভুক্তি চাচ্ছি। বর্তমান অর্থবছরে অন্তত দুই মাসের বেতন পেলেও চলতে পারবো। বাজেটের বরাদ্দ দেওয়া টাকা ফেরত না দিয়ে নতুন বাজেট প্রণয়নের আগেই বেতন দেওয়া যাবে। প্রতি মাসে ১০ কোটি করে টাকা দিলেই তা সম্ভব। অন্তত শিক্ষকরা ৩২ বছরের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবেন।’
সংগঠনটির সাবেক সভাপতি হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘এখন আর আন্দোলনে যাচ্ছি না। সরকার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দাবি ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। আমরা এখন নতুন বাজেটের আগেই আমাদের এমপিওভুক্তির দাবি জানাচ্ছি।’
বাজেটের আগেই কেন এমপিওভুক্তির দাবি জানতে চাইলে শিক্ষক নেতা হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘প্রতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বাজেটের যে টাকা ফেরত যায়, সেই টাকা এবার ফেরত না দিয়ে আমাদের এমপিওভুক্ত করা সম্ভব। আমরা এখন সেই অপেক্ষায় রয়েছি।’
বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষক আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক শিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন— সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে। আমরা অপেক্ষায় রয়েছি, বৈষম্যবিরোধী সরকার নিশ্চয় আমাদের ৩২ বছরের বঞ্চনার অবসান ঘটাবে।’
বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মেহরাব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৈঠকে আমাদের যেভাবে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তাতে শিক্ষকরা আশ্বস্ত হতে পারেননি। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ বিষয়ে ভূমিকা রাখছেন।’
পুলিশি নির্যাতনের পর গত ৩১ অক্টোবর বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সুপারিশপ্রাপ্ত ‘ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলি গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশী ঐক্য পরিষদের’ সাধারণ সম্পাদক মো. সাকিবুল ইসলাম এবং সংগঠনের রাজশাহী বিভাগের সমন্বয়ক মো. শরিফুল ইসলাম শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলির জন্য স্মারকলিপি জমা দিতে যান। শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সরকার যাতে গুরুত্ব দেয়, শিক্ষা উপদেষ্টাও যেন এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ভূমিকা রাখেন— এমন প্রত্যাশায় নিরুপায় দুই শিক্ষক শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের পা ধরে অনুনয়-বিনয় করেন। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
এ ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এরপর গত ১৬ নভেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ বগুড়ায় শিক্ষকদের একটি অনুষ্ঠানে এমপিওভুক্তির আশ্বাস দেন।
অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি নিজেই ডিল করছি। আশা করি, সরকার এমপিওভুক্তির বিষয়টি সুবিবেচনায় নেবে। সেটা হয়তো আগামী বাজেটের আগেই দেখতে পারবেন।’
তার বক্তব্যের প্রতি আস্থা রেখে বেসরকারি কলেজের অনার্স স্তরের শিক্ষকরা অপেক্ষায় আছেন— ৩২ বছরের বঞ্চনার অবসান ঘটাবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
আরও পড়ুন:
আশ্বাস পেয়ে রাস্তা ছাড়লেন শিক্ষকরা
‘৩২ বছর বঞ্চনার শিকার, এবার জুটেছে পুলিশি নির্যাতন’
পুলিশের লাঠিচার্জে ছত্রভঙ্গ শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি, আহত ৩৩ জন
অনিশ্চয়তা কাটছে না বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স স্তরের সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষকের
অনার্স-মাস্টার্স ও ডিগ্রির তৃতীয় শিক্ষকদের ‘ভাগ্য বিপর্যয়’ কাটবে কবে?