উত্তরাঞ্চলেও জনপ্রিয় হচ্ছে উচ্চ ফলনশীল ‘ব্রি ধান-১০৩’

আমন মৌসুমে ফলনের উন্নত জাতের ধান ‘ব্রি ধান ১০৩’। তুলনা বেশি ফলন এবং রোগ-বালাই ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হওয়ায় এই ধান চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত এই জাতটি উত্তরের জেলাগুলোতেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিশেষ করে দিনাজপুরের বেশ কিছু এলাকায় এ ধান চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। আর কৃষকদের মাঝে নতুন এই জাতের চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ‘ব্রি ধান ১০৩’ জাতটির কৌলিক সারি বিআর (বিআইও) ৮৯৬১-এসি২৬-১৬। এই ধান প্রথমে ব্রি ধান২৯ এর সঙ্গে এফএল৩৭৮ এর সংকরায়ণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এফ জেনারেশনে অ্যান্থার কালচার পদ্ধতি (জীব প্রযুক্তি) ব্যবহার করে হোমোজাইগাস গাছ তৈরি করা হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠে হোমোজাইগাস কৌলিক সারি নির্বাচনের পর তিন বছর ফলন পরীক্ষার করা হয়। পরে ওই কৌলিক সারিটি আমন ২০১৮ মৌসুমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এক পর্যায়ে কৌলিক সারিটির ফলন ব্রি ধান৪৯ এর চেয়ে বেশি হওয়ায় প্রস্তাবিত জাত হিসেবে নির্বাচিত হয়। যা পরে জাতীয় বীজ বোর্ডের মাঠ মুল্যায়ন দল কর্তৃক আমন ২০২১ মৌসুমে ব্রি ধান৮৭ (চেক জাত) এর সঙ্গে কৃষকের মাঠে প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়।

কৃষকের মাঠে ফলন পরীক্ষায় সন্তোষজনক হওয়ায় আমন মৌসুমের জন্য একটি জাত হিসেবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয় এবং কৃষকের মাঠে চাষাবাদের জন্য জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ২০২২ সালে জাতটি ছাড়করণ করা হয় বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, ব্রি ধান১০৩ এর জীবনকাল ব্রি ধান৮৭ এর প্রায় সমসাময়িক। গাছের কাণ্ড শক্ত, ডিগ পাতা খাড়া, লম্বা ও চওড়া । ধানের ছড়া লম্বা ও ধান পাকার সময় ছড়া ডিগ পাতার উপরে থাকে। ধান লম্বা এবং চাল সোজা। চালের আকার আকৃতি লম্বা ও চিকন হওয়ায় কৃষক ধানের দাম বেশী পাবে। চাল রফতানিযোগ্য। জাতটির গড় জীবনকাল ১২৮-১৩৩ দিন। এ জাতটির ফলন প্রতি হেক্টরে ৬ দশমিক ২ টন। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে জাতটি প্রতি হেক্টরে আট টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রোপা আমন মৌসুমে ব্রি ধান ১০৩ এর একটি প্রদর্শনী হিসেবে দিনাজপুরের হিলি উপজেলার বৈগ্রাম গ্রামের তিন কৃষকের মাঝে এ ধানের বীজ বিতরণ করা হয়। সেইসঙ্গে উৎপাদিত ধান বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করতে ওই তিন কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয় ১০টি ড্রাম। এসব বীজ আগামীতে নিজে রোপণ এবং অন্য কৃষকদের মাঝে বিতরণের জন্য রাখেন কৃষকরা। 

হিলির বৈগ্রাম গ্রামের কৃষক শাহিনুর রহমান বলেন, কৃষি অফিস থেকে পাওয়া ‘ব্রি ধান ১০৩’ জাতের নতুন ধান লাগিয়েছিলাম ২৫ কাঠা জমিতে। এই ধানের জাত যেমন ভালো তেমনই বীজও ভালো ছিল। এই জাতের ধান আবাদে পোকামাকড়ের আক্রমণ তুলনামূলক অনেক কম ছিল। এ কারণে তেমন কোনও কীটনাশক স্প্রে করতে হয় নাই। ধানের ফলনও ছিল বেশ ভালো।

তিনি বলেন, চাষ করে পাওয়া ধানগুলো বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করেছি, পরবর্তী মৌসুমে লাগাবো। আগামীতে আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এ ধান আবাদ করবো। অন্য কৃষকদের মাঝে বীজ ছড়িয়ে দেবো।

নতুন জাতের ধানের বীজ সংরক্ষণ করছেন এক কৃষক

একই গ্রামের কৃষানি রেহেনা আক্তার বলেন, স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে ব্রিধান ১০৩ নামে নতুন জাতের ধানের বীজ দিয়েছিল। সেই বীজ লাগিয়েছিলাম। এই ধানে রোগ-বালাই কম। এছাড়া ঝড়ে ধান গাছ হেলে পড়ার হারও খুব কম। চিকন ধান হওয়ায় দামও ভালো পাওয়া যায়। বিঘা প্রতি ফলন হয় ২০ মণ। অন্য ধানের তুলনায় এ ধান কিছুটা আগে পেকে যাওয়ায় দ্রুত কাটা যায়। এতে এই ধান আবাদের পর আলু ও সরিষাসহ রবিশষ্য আবাদ করা সম্ভব।

তিনি বলেন, আমাদের মাধ্যমে অন্য কৃষকদের মাঝে ব্রিধান ১০৩ এর বীজ ছড়িয়ে দিতে কৃষি অফিস থেকে বীজ দেওয়া হয়। সেই মোতাবেক আমরা ধানের বীজ কৃষি অফিসের দেওয়া ড্রামে সংরক্ষণ করেছি। সামনের দিনে নিজে যেমন বেশি করে আবাদ করবো, তেমনই অন্য কৃষকদের মাঝে বীজ ছড়িয়ে দেবো।

অপর কৃষক শরিফুজ্জামান বলেন, ব্রিধান ১০৩ নামে নতুন একটি জাতের ধান বীজ স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে আমাদের দেওয়া হয়। আমরা তিন জন কৃষক ছয় বিঘা জমিতে এই ধানের চাষ করি। আগামীতে এ ধানের আবাদ আরও বাড়াবো।   

হাকিমপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরজেনা বেগম বলেন, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রোপা আমন মৌসুমে ব্রিধান ১০৩ এর একটি প্রদর্শনী দেওয়া ছিল। ধানের এই জাতটি রোপা আমন মৌসুমের জন্য খুব ভালো একটি জাত। ব্রি থেকে উদ্ভাবিত রোপা আমনের এই জাতটি রোগ-বালাই প্রতিরোধী। একইসঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে আগাছা কম হয়। এ কারণে কৃষকদের ক্ষেত পরিচর্যা করাও সহজ হয়। মাঠ পর্যায়ে এর ফলাফল খুব ভালো পেয়েছি আমরা। বিঘা প্রতি এই জাতের ধানের ফলন হয়েছে প্রায় ২৫ মণ করে।

ধান বীজ সংরক্ষণের দিন কৃষকের সঙ্গে কৃষি কর্মকর্তারা

তিনি বলেন, আমরা যেহেতু রবি শষ্যের আবাদ বিশেষ করে সরিষা ও আলুর আবাদ বাড়াতে চাইছি, তাই ব্রি ধান ১০৩ চাষ করলে সময় কম লাগায় আগেভাগেই ধান কাটা যায়। এতে করে কৃষকরা খুব সহজেই সেই জমিতে রবি শষ্য আবাদ করতে পারেন।

যেকোনও গবেষণা বা উদ্ভাবনি জাত মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ হতে সময় একটু বেশি লাগে উল্লেখ করে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা কৃষক পর্যায়ে কৃষকের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করে সেই বীজ সংরক্ষণ করে আবারও কৃষকের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করেছি। এই উপজেলায় ব্রি ধান ১০৩ জাতের বীজ কৃষকরা সংরক্ষণ করেছেন। সেই সংরক্ষিত বীজ কৃষকদের মাঝে বিতরণের মধ্য দিয়ে এই জাত সম্প্রসারিত হবে বলে আশা করছি।’