হিলিতে চলতি মৌসুমে ধানের ভালো ফলন, খুশি কৃষকরা

দিনাজপুরের হিলিতে ইতোমধ্যেই রোপা আমন ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অন্যান্য বারের তুলনায় এবার ভালো ফলন হয়েছে ধানের। সেই সাথে ধানের দামও ভালো থাকায় দারুণ খুশি কৃষকরা। এতে করে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ভালো লাভের আশা কৃষকদের। ফলে আগামীতে উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ আরও বাড়বে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। এদিকে অন্যবারের তুলনায় ধানের উৎপাদন খরচ বেশি হলেও চাহিদা মাফিক ধানের দাম না পাওয়ায় খুব একটা লাভ হবে না বলে দাবি বর্গাচাষিদের।

শস্যভাণ্ডার খ্যাত দিনাজপুরের হিলিতে বর্তমানে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে শোভা পাচ্ছে সোনালি পাকা ধান। ধানের ভারে যেন নুয়ে পড়েছে বেশিরভাগ জমির ধান গাছ। ইতোমধ্যেই বেশিরভাগ জমির ধান পেকে যাওয়ায় ধান কাটা শুরু করেছেন কৃষকরা। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও রোগবালাই-পোকামাকড়ের তেমন আক্রমণ না থাকায় ধানের ভালো ফলন হয়েছে। বিঘা প্রতি ধানের ফলন হচ্ছে ১৬ থেকে ২০ মণ করে। আর প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ১৪শ টাকা দরে। এক বিঘা জমিতে ধান লাগানো থেকে কাটা পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে আর ধান বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। তাতে করে ১০ হাজার টাকার উপরে লাভ থাকছে। তবে সার ও কীটনাশকসহ অন্যান্য উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবারে উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। এতে জমির মালিককে দিয়ে কিছুই থাকছে না বর্গাচাষিদের। সারের দাম কমানো ও ধানের দাম বেশি হলে বর্গাচাষিরা লাভবান হতো। এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখীর কারণে যে মজুরি মিলছে তা দিয়ে সংসার চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ধানকাটা শ্রমিকরা।

HILI DHAN PIC 4হিলির খাট্টাউসনা গ্রামের কৃষক মিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার আবহাওয়া মোটামুটি ভালোই ছিল। পোকামাকড়ের আক্রমণ বিশেষ করে কারেন্ট পোকার আক্রমণ তেমন একটা ছিল না। মাজরা পোকাসহ কিছু পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলেও সময়মতো ওষুধ প্রয়োগ করায় ধানের তেমন একটা সমস্যা হয়নি। সবমিলিয়ে আবহাওয়া বেশ ভালো থাকার কারণে ধানের যে ফলন হয়েছে তাতে করে এবারে ধান চাষ করে লোকসান গুনতে হবে না। কৃষকরা বেশ লাভবান হবেন। বিঘা প্রতি ১৮ থেকে ২০ মণ করে ধান পাওয়া যাচ্ছে আর বর্তমানে বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে ১৪শ টাকা মণ দরে। সেই হিসেব করে এবারে ধান চাষাবাদ করে লাভ হবে। আমাদের এক বিঘা জমিতে ধান রোপণ থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত সব খরচ মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লেগেছে। বিঘা প্রতি ধানের ফলন হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ মণ। তাতে করে এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকা পাওয়া যাচ্ছে। এতে হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, ১৫ হাজার টাকা লাভ থাকছে।

HILI DHAN PIC 1হিলির ইসমাইলপুর গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আবহাওয়া বেশ ভালো থাকায় গতবারের চেয়ে ধানের ফলন ভালোই হয়েছে। এর পরে ধানের যে দাম যাচ্ছে তাতে করে দাম বেশ ভালোই রয়েছে। সেই হিসেবে ধান আবাদ করে লোকসান নেই। বিঘা প্রতি ধানের ফলন পাওয়া যাচ্ছে ১৮ থেকে ২০ মণ করে। সেই সাথে ধানের দাম ভালোই যাচ্ছে ১৩শ ৮০ থেকে ১৪শ টাকা মণ যাচ্ছে। এতে করে এবারে ধান আবাদ করে কৃষকরা ভালোই লাভবান হবেন। তবে অন্যবারের তুলনায় এবারে সার-কীটনাশকের দাম একটু বেশি হওয়ায় ধানের উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। সেই হিসেবে লাভ একটু কম হবে। তবে সার-কীটনাশকের দাম কম থাকলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হতে পারতো।

হিলির খাট্টাউসনা গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অন্যবারের তুলনায় এবারে ধানের উৎপাদন খরচ মোটামুটি ভালোই হয়েছে। এবারে সারের দাম বেশি। কীটনাশকের দামও বেশি। এমনকি শ্রমিকের মজুরি বেশি। সেই হিসেবে ধানের ফলন বেশ ভালোই হচ্ছে কিন্তু যে ধানের যে দাম তাতে করে খুব একটা পড়তা হবে না। যাদের ধানের ফলন ১৮ থেকে ২০ মণ হচ্ছে তাদের বেশ ভালোই লাভ হবে কিন্তু যাদের ১৫ থেকে ১৬ মণ বা তার কম হচ্ছে তাদের লাভ খুব একটু হবে না বাড়তি খরচের কারণে। যে হারে উৎপাদন খরচ বাড়ছে সেই হিসেবে ধানের দাম আরেকটু বেশি ১৫শ থেকে ১৬শ টাকা হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু বর্তমানে যে বাজার রয়েছে ১৪শ টাকা, সেটিও স্থির থাকছে না। প্রথম দিকে থাকলেও মাঝে মধ্যে নিচে নেমে যাচ্ছে। সেই হিসেব করে যাদের নিজেদের জমি রয়েছে তারা লাভবান হতে পারবেন। কিন্তু যারা বর্গাচাষি, খরচ দিয়ে তাদের খুব একটা লাভ হবে না। 

HILI DHAN PIC 6হিলির জালালপুর গ্রামের বর্গাচাষি কৃষক সুজন হোসেন বলেন, আমি মানুষের জমি আদি নিয়ে রোপা আমন ধান চাষাবাদ করেছি। জমির মালিককে বিঘা প্রতি ৬ মণ করে ধান দিতে হবে, সেই হিসেব করে যদি এক বিঘাতে যদি ১৫ থেকে ১৬ মণ ধান হয়। তাহলে জমির মালিককে দিয়ে মাত্র ৯ থেকে ১০ মণ ধান টিকবে। একবিঘা জমির ধান লাগানো থেকে কাটা পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লাগছে। বর্তমানে যে ধানের দাম তাতে করে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা পাওয়া যাচ্ছে। খরচ বাদ দিলে ২ হাজার টাকার মতো লাভ থাকছে। তাই ধানের দামটা যদি ১৫শ থেকে ১৬শ টাকা থাকতো সেই সাথে সার-কীটনাশকের দামটা যদি কম হতো তাহলে একটু লাভের মুখ দেখতে পেতাম। কিন্তু বর্তমানে যে অবস্থা তাতে করে গায়ে গায়ে শোধ আর খেরটাই লাভ আর আমি একটা মানুষ যে শ্রম দিলাম তার কোনও দাম পাচ্ছি না।

ধানকাটা শ্রমিক শেরেগুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে দাম, সেই হিসেবে আমাদের শ্রমিকদের মজুরি কম। বর্তমানে ৫শ থেকে সাড়ে ৫শ টাকা মজুরি দিয়ে আমাদের শ্রমিকদের তেমন একটা পড়তা নেই। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেশি। আলুর কেজি ৭০ টাকা, চাউলের দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এত দামের কারণে এই মজুরি দিয়ে তো আমাদের সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই মজুরি দিয়ে চাল কিনলে তরিতরকারি হচ্ছে না, এমন অবস্থায় ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ জোগাবো কীভাবে। সব জিনিসের দাম বেশি। যার কারণে এই মজুরি দিয়ে ধানকাটা শ্রমিকদের দিন ভালোভাবে যায় না। তাই ধানকাটা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের বিবেচনা করা দরকার।         

HILI DHAN PIC 2হাকিমপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরজেনা বেগম বলেন, বর্তমানে রোপা আমন ধান কাটা চলছে। এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৮২২ হেক্টর জমির ধান অর্থাৎ ৭২ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। যা এখনও চলমান রয়েছে। আশা করছি, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ধান কাটা সম্পূর্ণ হবে। এ বছরে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আমন ধানের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। পাশাপাশি এবার ভালো দাম পাওয়ার কারণে কৃষকরা লাভবান হওয়ায় তারা বেশ খুশি। আগাম যে ধানের জাত ব্রি-ধান ৭৫, ৮৭, ১০৩ এই জাতগুলোর ফলন বিঘা প্রতি ২১ থেকে ২২ মণ পর্যন্ত কৃষকরা পেয়েছে। যা বিগত দু থেকে তিন বছরের তুলনায় এবারের অনেক বেশি। আগামীতে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে কৃষকরা আগাম জাতের ধান ও উচ্চ ফলনশীল ধানগুলো চাষাবাদে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবেন। চলতি মৌসুমে হাকিমপুর উপজেলায় ৮ হাজার ১১৭ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। যা থেকে ২৮ হাজার ৮১৫ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, ধান উৎপাদনের সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।