পাবনার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, ফরিদপুর, রাজশাহীর চারঘাট, বাঘা এবং নাটোরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একসময়ের খরস্রোতা বড়াল নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। দখল-দূষণে এখন মৃত নদীটি।
একসময় প্রবাহিত নদীকে ঘিরেই তিন জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল হাটবাজার ও ব্যবসাকেন্দ্র। নদীটিকে কেন্দ্র করেই বহু মানুষ জীবন-জীবিকার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। নদীর পানি দিয়েই কৃষকরা দুই পাড়ের শত শত হেক্টর জমিতে ধান, গম, পাট, আখসহ নানান ফসল ফলাতেন। এখন সেটি যেন শুধুই স্মৃতিকথা। সেই খরস্রোতা নদীটি এখন মরা খালে রূপ নিয়েছে। এর তলদেশে চাষ করা হয় বিভিন্ন ফসল। দখল-দূষণ আর অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলছেন, নদীর বুকে পলি জমে উঁচু হয়ে গেছে। দখল আর দূষণের কারণে দুই পাড় চেপে গেছে। ফলে খরস্রোতা বড়াল নদী আজ পরিণত হয়েছে মরা খালে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ও অকাল-বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য বড়াল নদীর উৎপত্তিস্থলে একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া আটঘড়িয়া, দহপাড়ায় ও চাটমোহরে ক্রস বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলে প্রায় তিন যুগ সময় পদ্মার পলিযুক্ত পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বড়াল নদীতে বন্ধ থাকায় নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া দুই পাড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কলকারখানা ও বাড়িঘর নির্মাণ করে নদী দখল করে চলেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘রাজশাহীর পদ্মা থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বড়ালসহ প্রায় ১০টি নদী আছে। পদ্মা থেকে বাঘাবাড়ি ২২০ কিলোমিটার নদীপথের মধ্যে দখল করে ৫৬টি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। নাটোরে ও চারঘাট এলাকায় দুটি স্লুইসগেট হয়েছে। এগুলো অপসারণ করা হলেই নদী আবারও প্রাণ ফিরে পাবে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। অচিরে স্থাপনা ও স্লুইসগেট ভেঙে ফেলা হবে। যদি তা না হয়, তাহলে আন্দোলন গড়ে তুলবো আমরা।’
বড়াল নদীর বিভিন্ন স্থানে স্লুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন বাঘা উপজেলার আড়ানী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সাহাবাজ আলী। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে স্লুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্রমান্বয়ে বড়াল নদী শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। এখন বড়ালের তলদেশে কৃষি আবাদ হয়। বর্ষায় পানি জমলেও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়।’
বাঘার আড়ানী গোচর গ্রামের কৃষক একরাম আলী বলেন, ‘শুকিয়ে যাওয়ায় এলাকার কৃষকরা নদীর বুকে ফসল আবাদ করেন। পুরো মৌসুম গবাদিপশুর চারণ ক্ষেত্র হয়ে থাকে। একসময় বড়ালের পানি দিয়ে নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ জমিতে ফসল ফলাতেন। এখন নদীতে নলকূপ বসিয়ে ধান চাষ করতে হয়।’
বাঘা উপজেলার রুস্তমপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মজবুল হোসেন লাল্টু বলেন, ‘বড়াল নদীতে পানি না থাকায় দুই পাশে উঠা ব্যবসা কেন্দ্রগুলো ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সেচসহ প্রতিদিনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এখনই সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে পুনঃখনন না করলে বড়াল তার ঐতিহ্য হারিয়ে বিলীন হয়ে যেতে পারে।’
গোচর গ্রামের কৃষক আশরাফ আলী বলেন, ‘বড়ালে বর্তমানে পানি নেই। তলদেশে কৃষি আবাদ করতে গিয়ে পাশে বসানো জমি থেকে সেচ দিতে হচ্ছে।’
আড়ানী পৌর বাজারের ব্যবসায়ী একরামুল হক বলেন, ‘আমার বাবাও ব্যবসায়ী ছিলেন। এই নদী দিয়ে আগে নৌকাবোঝায় করে মালামাল আনা নেওয়া হতো। পলি জমে নাব্যতা সংকটের কারণে বছরের অধিকাংশ সময় নদীটি থাকে ধু ধু বালুচর। খনন না করায় বালুচরে রূপ নিয়েছে। এতে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে কৃষকরা। নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহার করতে না পারায় ফসল উৎপাদনে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হয়।’
নদীর বিভিন্ন স্থানে স্লুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণের ফলে শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন আড়ানীতে বড়াল নদীর পাশে বসবাসকারী শফি মন্ডল। তিনি বলেন, ‘বর্ষায় কিছু পানি জমলেও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়। তখন এলাকার কৃষকরা নদীর বুকজুড়ে ফসল আবাদ করেন। একসময় বড়ালের পানি দিয়ে নদী তীরবর্তী মানুষজন তাদের জমিতে ফসল ফলাতেন। এখন সে নদীর বুকে অগভীর নলকূপ বসিয়ে চলে বোরো চাষ। বড়াল আছে, নৌকা আছে, নেই শুধু পানি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বাঘা উপজেলার সাধারণ সম্পাদক হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রভাবশালীদের দখলদারত্বের কারণে দুই পাড় ক্রমান্বয়ে ছোট গেছে। এমনকি নদীর পাড়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা। যা একসময়ের খরস্রোতা বড়ালের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।’
এ বিষয়ে বড়াল নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খননের মাধ্যমে বড়ালের প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ সচল করতে হবে। চারঘাট ও রামাগাড়িসহ সব স্লুইসগেট ও বাঁধ অপসারণ করতে হবে। তবেই আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে খরস্রোতা বড়াল। এখনই সরকার উদ্যোগ না নিলে বড়াল নদী মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যাবে।’
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে বড়ালে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষিক্ষেতে পানি দিতে অসুবিধা হয় কৃষকদের। নদীটি দ্রুত খনন করা প্রয়োজন।’
চারঘাট উপজেলার কৃষক জারজিস শেখ বলেন, ‘উৎসমুখে অপরিকল্পিত খননে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে পদ্মার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেই তবে বড়াল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। পদ্মার মুখে পলিমাটি জমে পানির প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড়াল আজ নিজের অস্তিত্ব হারিয়েছে। সেচসহ প্রতিদিনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।’
চারঘাট উপজেলার কলেজশিক্ষক নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে নদী তীরবর্তী উপজেলাগুলো বন্যামুক্ত করার জন্য উৎসমুখ চারঘাটে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া উৎসমুখ থেকে নদী দখলের ফলে ধীরে ধীরে সরু খালে পরিণত হয়। বড়াল পুনঃখনন করে অবাধ পানিপ্রবাহের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা ফিরেয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি।’
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রিফাত করিম বলেন, ‘বড়াল পুনঃখননের জন্য ইতিমধ্যে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি শেষে ৫২৮ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হলে প্রথম ফেইজে বড়ালের ৪৮ কিলোমিটার, নারদ নদের ৪৩ কিলোমিটার, মুসা খান নদীর ছয় কিলোমিটার পুনঃখনন করা হবে।’