কৃষকের তিন হাজার সূর্যমুখীতে ফুটে উঠলো ‘অমর ২১’

ঢাকার পরে রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল ভাষা আন্দোলন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে লন্ঠন, মশাল আর হারিকেন জ্বালিয়ে রাজশাহী কলেজের ছাত্ররা সারা রাত জেগে রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের মাঠে ইট ও কাদা দিয়ে বানিয়েছিলেন স্মৃতিস্তম্ভ। নির্মাণ শেষে শহীদ মিনারের নামকরণ করা হয়েছিল ‘শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ’। শহীদ মিনারের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘সুপ্রভাত’ কবিতার অমর ২ চরণ। কিন্তু আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনারের স্বীকৃতি আজও মেলেনি। 

বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) খোলা আকাশের নিচে এমন অমর একুশ দেখা গেলো রাজশাহী কলেজে। ৫২-তে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য এ কলেজ প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছিল আন্দোলন। সেই কলেজে অমর একুশ দেখতে এসেছিলেন ভাষা সংগ্রামী, শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা। সবুজ পাতার গালিচা। তার ওপরে হলদে ফুলে লেখা ‘অমর ২১ ’। সেই লেখাটিকে আবার সাজানো হয়েছে ফুলে, পাতায়।

পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলনে ছাত্রসমাজের বাইরেও অংশ নিয়েছিলেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ছিলেন হাজারো কৃষক। সেই কৃষকের অবদান ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে দেশের যেকোনও ক্রান্তিলগ্নে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগটি নেন রাজশাহীর কৃষক মনিরুজ্জামান মনির। মূলত ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরেই তার এই পরিকল্পনা।

আয়োজক কৃষক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ভাষা-সংগ্রামের ইতিহাস এবং তাৎপর্য ও কৃষকের অবদান সবাইকে জানাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মূলত ২১ ফেব্রুয়ারি আয়োজনটি করার ইচ্ছে থাকলেও সেদিন ফুলগুলো পূর্ণতা পায়নি। তাই কয়দিন পরে এ ফেব্রুয়ারিতেই ফুটিয়ে তোলা হলো অমর একুশ।’

সুনিপুণ হাতে কলেজের কংক্রিটের ওপর ৩০ হাজার সূর্যমুখী ফুলে অমর একুশ ফুটে ওঠার সে খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। যা একনজর দেখতে ভিড় জমান অনেক দর্শনার্থী। তারা ফুল দিয়ে তৈরি ‘অমর ২১’-এর সঙ্গে নিজেদের ফ্রেমবন্দি করার পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের অবদানকে স্মরণ করেন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গেই।

এদিকে শিক্ষার্থীরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও চেতনা সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও শহীদদের অবদান সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উৎসাহিত করে। সূর্যমুখী ফুলের মাধ্যমে 'অমর একুশ' লেখার এই অভিনব উপস্থাপনা আমাদের মধ্যে একুশের চেতনা জাগিয়ে তুলেছে। এমন উদ্যোগগুলো আমাদের প্রজন্মকে আরও আলোকিত করবে এবং ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সহায়তা করবে।

ব্যতিক্রমী এ আয়োজন দেখতে এসেছিলেন বায়ান্নোতে রাজশাহীতেই ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জিও। তিনি জানালেন নিজের অনুভূতিও। এই ভাষাসৈনিক বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষার জন্য রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীদের অবদান কম নয়। ঢাকার পরেই আমরা রাজশাহীতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। ঢাকার রাস্তায় গুলি চললে আমরাই প্রথম এই কলেজে রাতারাতি শহীদ মিনার নির্মাণ করেছিলাম। আমাদের চাওয়া, এই শহীদ মিনারটিকে যেন দেশের প্রথম শহীদ মিনারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।’

আয়োজককে ধন্যবাদ জানিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ মু. যহুর আলী বলেন, ‘এ ধরনের আয়োজন আমাদের ভাষা-সংগ্রামের ইতিহাস ও মর্যাদাকে সমুন্নত করে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক মনিরুজ্জামান এ আয়োজন করেছেন। এ জন্য তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা।’