রাজশাহীতে আমের বাজার লাগামহীন, দাম বেড়েছে দ্বিগুণ

রাজশাহীতে বাগানের গাছ থেকে আম পাড়া ও বিক্রির সময়সূচি বা ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’ অনুযায়ী, বাজারে এখন পাওয়া যাচ্ছে গোপালভোগ, লখনা, খিরসাপাত ও গুটি আম। আমের রাজধানী খ্যাত এ অঞ্চলে মৌসুমের এই সময়ে দাম সবসময় কম থাকে, তবে এবার চিত্র ভিন্ন। ফলন কমের অজুহাতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে আমের দাম। গত বছরের তুলনায় এবার জাতভেদে আমের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

রাজশাহীর পাইকারি ও খুচরা আমের বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, হাঁকডাকে জমে উঠছে আমের বাজার। দাম বেশি হওয়ায় নিম্নমধ্যবিত্তের মুখে আমের স্বাদ নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে, বলছেন ক্রেতারা।

আমের পাইকারি বাজারের মোকাম রাজশাহীর বানেশ্বর বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে গোপালভোগ আম ৩৭০০ থেকে ৩৮০০ টাকা, খিরসাপাত ৪০০০ থেকে ৩০০০ টাকা, লখনা ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা ও গুটি আম ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।

একই বাজারে দুই দিন আগে গোপালভোগ ২৮০০ থেকে ৩৪০০ টাকা, খিরসাপাত ২৮০০ থেকে ৩২০০ টাকা, লখনা ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা ও গুটি আম ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে।

Rajshahi Mango News 08.06 (1)পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর এলাকার আমিনুল ইসলাম নামে আমের ব্যবসায়ী বলেন, গতবছর এসময় গোপালভোগ আম ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা মণ ছিল, সেটি এবার সাড়ে ৩ হাজারের নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। গুটি আম ৮০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা মণ ছিল, সেই আম এবার ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খিরসাপাত আমও গতবার ১৮০০ থেকে ২০০০ ছিল, এবার ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে আম কম আমদানির কারণে দাম বেশি বলে জানান ওই ব্যবসায়ী।

রাজশাহীর বাঘার আমচাষী শফিকুল ইসলাম সানা গতবছর প্রায় এক কোটি টাকার আম বিক্রি করেছিলেন। তার মধ্যে ২৬ মেট্রিক টন আম বিদেশেই রফতানি করেন। শফিকুল ইসলাম এবছরও ৩০০ বিঘা জমিতে আমের চাষ করছেন। এ বছর গাছে অর্ধেকেরও কম আম এসেছে বলে জানান। তবে বাঘার অন্য চাষিদের তুলনায় তার অবস্থা কিছুটা ভালো। পরিচর্যা বেশি নেওয়ায় আমের আকারও ভালো হয়েছে।

Rajshahi Mango News 08.06 (13)শফিকুল ইসলাম সানা বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালে ৫০ শতাংশের মতো আম পড়ে গেছে। তারপরও আমার বাগানে ৪০ শতাংশের মতো আম আছে। তবে অন্য চাষিদের অবস্থা আরও খারাপ। ২০ শতাংশের কম আম এসেছে তাদের বাগানে।

তিনি আরও বলেন, গত বৃহস্পতিবার তিনি ৩০০ কেজি গোপালভোগ বিক্রি করেছেন আর শুক্রবারে ৫০০ কেজি। এক্সপোর্ট সাইজ গোপালভোগ ৪ হাজার টাকা মণ বিক্রি করেছেন, যেগুলোর প্রতিটি আমের ওজন ২০০ গ্রামের ওপরে।

রাজশাহী অঞ্চলে এ বছর গাছে দেরিতে মুকুল এসেছে। মুকুলও কম এসেছিলো। মুকুল আসার কিছুদিন পর শিলাবৃষ্টিতে কিছু ঝরেও পড়ে। এরপর এপ্রিল মাসেই তীব্র তাপদাহ বয়ে যায়। তাতেও আমের গুটি ঝরে পড়ে। শেষে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণেও রাজশাহীর আম ঝড়ে পড়ে। গত বৃহস্পতিবারও (৬ জুন) ঝটিকা ঝড়ে অনেক আম পড়েছে। 

Rajshahi Mango News 08.06 (8)চারঘাট উপজেলার আমচাষী ডাবলুর ২০ বিঘা আমের বাগান। বিভিন্ন জাতের আমের চাষ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই আমকে টিকে থাকতে হয়। তবে আমের যারা পরিচর্যা নেন তাদের গাছে আম ভালো থাকে। গতবারের চেয়ে কিছুটা কম এলেও আমার সব গাছেই মোটামুটি আম আছে। পরিচর্যার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (অবসরপ্রাপ্ত) ড. আলীম উদ্দীন বলেন, আবহাওয়াগত কারণে আমের ফলনে অনেকটা তারতম্য ঘটে। আবার একবছর আমের ফলন ভালো হলে পরের বছর স্বাভাবিকভাবে গাছে কম আম আসে। এবার শীতকাল দীর্ঘ সময় থাকায় গাছে মুকুল কম এসেছে। আবার তাপদাহের কারণেও আমার ফলনে তারতম্য হয়েছে। সবমিলিয়ে এবার আমের অফসিজন। তারপরও এখন যেহেতু নানা জাতের আমের চাষ হয়, তাই এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। একটা আমের ফলন ভালো না হলে অন্য আমের ফলন ভালো হচ্ছে। এবার গোপালভোগ, খিরসাপাত, হিমসাগর ও লখনা আমের ফলন কম হলেও বারি আম-৩, বারি আম-৪ ও বারি আম-১১ এর ফলন ভালো হয়েছে। এই আম বিক্রি করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

রাজশাহী নগরীর বহরামপুর এলাকার শিক্ষক ওয়াসিম আকরাম ওরফে আবিব জানান, এবার আমের বাজার চড়া। তাই অল্প করে কিনছে বেশিরভাগ মানুষ।

Rajshahi Mango News 08.06 (4)নগরীর অটোরিকশাচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, এই মৌসুমে এখনও আমের দিকে নজর দেওয়া হয়নি। কারণ একদিন কিনতে গিয়ে দেখি দাম গতবারের তুলনায় বেশি। তাই সুবিধা অনুযায়ী সংসারের খরচ বাঁচিয়ে মৌসুমের ফল পরিবার নিয়ে খাবো।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯৩ হাজার ২২৪ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয়েছে বারি আম-৩ বা আম্রপালি, ২৪০১১ হেক্টর জমিতে। এরপর রয়েছে যথাক্রমে আশ্বিনা ১৩৭৩০ হেক্টর, ফজলি ১১৯৭৭ হেক্টর, লক্ষণভোগ ৯৬৬৯ হেক্টর, খিরসাপাত ৯০২১, ল্যাংড়া ৬৭১৫ এবং বারি আম-৪ চাষাবাদ হয়েছে ৩৬৬২ হেক্টর জমিতে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালক ড. মো. মোতালেব হোসেন বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর এবং নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, সাপাহার ও পত্মীতলার উঁচু বরেন্দ্রভূমিতে কৃষি উদ্যোক্তারা নতুন বাগান করেছেন। এসব বাগানে বারি আম-৩ বা আম্রপালি, বারি আম-৪, কাটিমন, গৌড়মতিসহ নতুন জাতের আমগুলো ‘অফইয়ার’, ‘অনইয়ার’ মেইনটেইন করে না। এসব জাতের গাছে প্রতিবছরই আম ধরে। এসব গাছে আম ভালো ধরে। অন্যদিকে গোপালভোগ, ল্যাংড়া, খিরসাপাত জাতের কমন আমগুলোতে একবছর বেশি আম এলে সাধারণত পরের বছর কিছুটা কম আম আসে। এই আমগুলো রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে বেশি হয়। এসব গাছে এবার কম আম এসেছে। এছাড়া দীর্ঘ তাপপ্রবাহের কারণেও আমের ফলন কম হয়েছে। এরপরও দাম ও ফলন মিলিয়ে কিছু চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আবার অনেক চাষি লাভবান হতে পারেন।