প্রচণ্ড দাবদাহে বিপর্যস্ত রাজশাহীর জনজীবন

তৃষ্ণার্ত দুজন পানি পান করছেনঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে সৃষ্ট বৃষ্টিপাতে কয়েকদিন স্বস্তিতে ছিল রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ। তবে এর প্রভাব কেটে যাওয়ার পর, এই অঞ্চলের মানুষ প্রচণ্ড রোদ আর গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। গত কয়েকদিন ধরে সর্বোচ্চ ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করছে রাজশাহীতে। রমজানের মধ্যে ভ্যাপসা গরম আর লু হাওয়ায় রাস্তা-ঘাটে কমে গেছে মানুষের চলাফেরা। ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না প্রান্তিক মানুষেরা। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী। আবহাওয়া অফিস বলছে, আরও দুই-তিন দিন এ ধরনের পরিস্থিতি থাকাতে পারে।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডা. শামসুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গরমের কারণে দেড় মাস ধরে ডায়রিয়া রোগী গড়ে প্রত্যেক দিন ৬০ জন করে ভর্তি হচ্ছেন। এছাড়াও তীব্র রোদের কারণে মাথা ব্যাথাসহ বিভিন্ন রোগী ভর্তি হয়।’ তিনি বলেন, ‘রোদের কারণে হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার অনেকে গরম থেকে একটু শান্তি পাওয়ার জন্য খোলা জায়গায় বিক্রি করা আখের রসসহ বিভিন্ন কোমল পানীয় খেয়ে থাকেন। এখানে অপরিষ্কার পানি ব্যবহার হয়ে থাকে। এতে করে ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এই গরমে সুস্থ থাকতে হলে, নিরাপদ পানি বেশি বেশি করে পান করতে হবে। সেইসঙ্গে  তীব্র রোদ এড়িয়ে চলতে হবে।’

হাসপাতালের আঙিনায় গাছের ছায়ায় রোগী দুই দিন আগে পেটের পিড়া নিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বগচর এলাকার সামির রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন, কিন্তু বেড পাননি। ওয়ার্ডের বারান্দায় ঠাঁই হয়েছে তার। শুক্রবার (১০ মে) বিকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্বামীকে (সামির) নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ফাঁকা জায়গায় সবুজ ঘাসের ওপরে মাদুর বিছিয়ে বসে আছেন মাসতুরা বেগম। রোগী নিয়ে এখানে কেন, জানতে চাইলে মাসতুরা বেগম বলেন, ‘বারান্দায় প্রচণ্ড গরম। তাই গরম থেকে বাঁচার জন্য এখানে বসে আছি। কিন্তু এখানেও তেমন শান্তি নেই। তেমন বাতাস নেই। তবে হাসপাতালের বিল্ডিংয়ের কারণে ছায়া পড়ায় এখানে একটু ভালো লাগছে। তাই তাকে (স্বামী) নিয়ে এখানে বসে আছি।’

রাজাবাড়ি হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মশিউর রহমান বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমের কারণে স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কমে গেছে। আগে যখন গরম ছিল না, তখন ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত উপস্থিতি থাকতো। আর এখন ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়।’

তৃষ্ণা মেটাতে আখের জুস রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক রাজিব খান বলেন, ‘শুক্রবার (১০ মে) রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন ২৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকালে বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৪ শতাংশ। আর বিকালে ৫৫ শতাংশ।’

রাজশাহী নগরীর পিএন স্কুলের পাশে অনেকগুলো রিকশা স্ট্যান্ড করা আছে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন রিকশাচালক জানান, গরম ও রোদের কারণে মানুষ বের হয় না। এতে করে রাস্তায় তেমন মানুষজনও নেই। তাই রোদে খালি রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে এখানে স্ট্যান্ড করে বিশ্রাম নিচ্ছি। এর ফাঁকে সাগর নামের এক রিকশা চালক জানান, কয়েকদিন ধরে গরম ও রোদের কারণে প্রত্যেক দিন ৫০০-৫৫০ টাকা ভাড়া মারতে পারি। এতে করে রিকশার জমা খরচ সাড়ে তিনশ টাকা বাদে সংসার চালানোর জন্য তেমন রাখতে পারি না। সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। কবে যে রাজশাহী আবহাওয়া ঠাণ্ড হবে!

প্রচণ্ড গরমে কাজ করছেন এক নারী শ্রমিকনগরীর তেরখাদিয়া এলাকায় মোখলেসুর রহমান তিনরুমের বাড়িতে থাকেন। তার বাড়ির একটি কক্ষে দেড় টনের একটি এসি লাগানো আছে। তিনি জানালন, অন্য কক্ষে এসি না থাকায় পরিবারের সবাই একটি কক্ষে শীতল বাতাসের জন্য ভর করি।’

গোদাগাড়ী উপজেলার মহিশালবাড়ী বাজারে সনি-র‌্যাগসের ডিলার হিসেবে আছেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গ্রামে অঞ্চলে এখন এসি ক্রয় করছেন। এই মৌসুমে ১৫টি এসি বিক্রি করা হয়েছে। আরও চাহিদা রয়েছে। এভাবে গরম পড়তে থাকলে এসি বিক্রি বাড়বে। এক সময় এসি ঘরে লাগালে বিলাসিতা ভাবা হতো। কিন্তু এখন গরম থেকে বাঁচার জন্য এসি প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।’

গরমে পানিতে নেমে কয়েকজন গোসল করছেননগরীর রানীনগর এলাকার রায়হানুল ইসলাম বিপুল বলেন, ‘আমার তিনজনের সংসার। কাজ করে সংসার চালায়। রাজশাহীতে এখন প্রচণ্ড রোদ-গরম। আমি যেখানে কাজ করি সেখানে এসি থাকায় সমস্যা কিছুটা কম হয়, কিন্তু বাইরে প্রচণ্ড গরমে থাকা দায়।’

নগরীর আমবাগান এলাকার রুহুল আমিন বলেন, ‘আগে বাড়ির ছাদের ওপরে রাখা টবের গাছের গোড়ায় একদিন পরপর পানি দিলেই চলতো। কিন্তু এখন সকাল-বিকাল পানি না দিলে, গাছের পাতা নেতিয়ে পড়ে।’

গরমে গরুগুলো পুকুরে নেমে পড়েছে রাজশাহীতে কেন এত গরম, এমন প্রশ্নের জবাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের প্রফেসার ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘উষ্ণমণ্ডলীয় এই দেশে এ সময় রাজশাহীতে সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়। ফলে ভূ-ভাগ তাড়াতাডি উষ্ণ হয়ে পড়ে এবং তাপদাহ বাড়তে থাকে। এ ছাড়া এখানকার বায়ুতে জলীয়বাষ্পও বেশি। এজন্য গরম বেশি লাগে। সৌদি আরবে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকলেও তেমন গরম অনুভূত হয় না। কারণ সেখানে বায়ুতে জলীয়বাষ্প খুবই কম। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রাজশাহীতে তাপের তীব্রটা আরও বেড়েছে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন প্রফেসার ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার। তিনি বলেন, এটা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পদ্মা নদীতে পর্যাপ্ত পানি রাখতে হবে। গাছকাটা বন্ধ করতে হবে। তৈরি করতে হবে বনানয়ন। যাতে বৃষ্টিপাত বাড়ানো যায়।