পানির অভাবে বোরো আবাদ নিয়ে দিশেহারা চাষিরা

ময়মনসিংহে তীব্র খরায় পানির স্তর নেমে গভীর নলকূপে পানি না আসায় বোরো ধানক্ষেতে সেচ দিতে পারছেন না কৃষকরা। শেষ মুহূর্তে সেচের পানির অভাবে বোরো ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তারা। ধান ঘরে তুলতে না পারলে জমি প্রস্তুত ও ধান লাগানো বাবদ বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে তাদের।

কৃষকদের অভিযোগ, বোরো ধানের আবাদ এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লেও পানির সমস্যা সমাধানের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়নি কৃষি বিভাগ। তবে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, সমস্যা সমাধানে সেচের বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তারা। এখনও এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

সদরের পাড়াইল বাইরপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান আকন্দ (৭৫) চলতি বোরো মৌসুমে ২০ হাজার টাকা সুদের ওপর নিয়ে ৪৫ শতক জমিতে হাইব্রিড ৭৭৭ জাতের বোরো ধানের আবাদ করেছেন। ক্ষেতের অর্ধেক ধান এখন বের হয়েছে। এর মধ্যে পানির স্তর নেমে গিয়ে গভীর নলকূপে পানি না আসায় সেচ কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় সেচ দিতে পারছেন না। 

শেষ মুহূর্তে পানি দিতে না পারলে ধান চিটা হয়ে ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কায় আছি জানিয়ে এই কৃষক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুদে টাকা নিয়ে বোরো আবাদ করেছি। ফলন ভালো আশা করেছিলাম। শীষ থেকে ক্ষেতের বেশিরভাগ ধান বের হয়ে গেছে। আগামী ২০-২৫ দিনের মধ্যে পাক ধরে আসতো এবং কেটে ঘরে তুলতে পারতাম। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে গভীর নলকূপে পানি না আসায় সেচ বন্ধ হয়ে গেছে। ১৫ দিন ধরে ক্ষেতে পানি দিতে পারছি না। নলকূপ সমিতির লোকজন বলছেন পানির স্তর নেমে যাওয়ায় নলকূপে পানি আসছে না। এ কারণে মেশিন চালু হচ্ছে না। এই মুহূর্তে পানি দিতে না পারলে ধানের ফলন ভালো হবে না। ধান চিটা হয়ে যাবে। ধান ঘরে তুলতে না পারলে সুদে নেওয়া ঋণ পরিশোধ কীভাবে করবো, আর পরিাবরের সদস্যদের নিয়ে কীভাবে খাবার জোগাবো; এই দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না।’  

গত দুই সপ্তাহ ধরে পানি না আসায় বেশিরভাগ গভীর নলকূপ বন্ধ হয়ে গেছে, পানির খোঁজ করছেন কৃষকরা

শুধু আব্দুর রহমান নন, জেলার অধিকাংশ কৃষকের একই অবস্থা। গত দুই সপ্তাহ ধরে পানি না আসায় বেশিরভাগ গভীর নলকূপ বন্ধ হয়ে গেছে। 

কৃষকদের অভিযোগ, মৌসুমের শেষে এসে সেচ দিতে না পারলে ধান ঘরে তুলতে পারবেন না। আর এ বিষয়ে কৃষি বিভাগের কোনও সহায়তা পাচ্ছেন না তারা। 

একই এলাকার কৃষক শাহজাহান বলেন, ‘ক্ষেতের বেশিরভাগ ধান বের হয়ে গেছে। এখন পানি দিতে পারলে ধান পরিপক্ব এবং ফলন ভালো হতো। কিন্তু সেচ দিতে না পারলে গাছ শুকিয়ে ধান চিটা হয়ে যাবে। ফলন ভালো হবে না। পানি দেওয়ার জন্য গভীর নলকূপের মেশিন ঘরে কৃষকরা এসে ভিড় করছেন প্রতিদিন। এই সময়ে কৃষকের পাশে কৃষি বিভাগের কোনও কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি।’

গোপালনগর গ্রামের কৃষক মোজাম্মেল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার তেমন বৃষ্টি হয়নি। গভীর নলকূপ বন্ধ হওয়ায় বোরো ধান গাছ মরে যাচ্ছে। বোরো আবাদ ঘরে উঠাতে পারবো কিনা এ নিয়ে চিন্তিত আছি এলাকার সব কৃষক। এর আগে কখনও এরকম সমস্যায় পড়তে হয়নি আমাদের।’    

এদিকে, গভীর নলকূপ বন্ধ হওয়ায় পানি দিতে না পারায় কৃষকদের তোপের মুখে পড়েছেন নলকূপ পরিচালনাকারী সমিতির সদস্যরা। সদর উপজেলার পাড়াইল বাইরপাড়া গভীর নলকূপ সমিতির ম্যানেজার আব্দুল গণি আকন্দ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে গভীর নলকূপ পরিচালনা করছি। কৃষকদের সেচ দিয়ে আসছি। এরকম সমস্যায় জীবনেও পড়তে হয়নি। এবারই প্রথম পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মেশিন চালু করলেও পানি না আসায় নলকূপ চালু হচ্ছে না। প্রতিদিন পানির জন্য মেশিন ঘরের সামনে কৃষকরা ভিড় করছেন। তাদের জবাব দিতে পারছি না। সমস্যা সমাধানে কৃষি বিভাগ কিংবা বিএডিসির কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের খোঁজখবর নেয়নি। পানির সমস্যায় এখন আমরা দিশেহারা।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার দুই লাখ ৬৩ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ লাখ ৩৮ হাজার ২২৩ মেট্রিক চন। 

পানি দেওয়ার জন্য গভীর নলকূপের মেশিন ঘরে কৃষকরা এসে ভিড় করছেন প্রতিদিন

এ বিষয়ে জানতে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. নাসরিন আক্তার বানুর মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে সদর উপজেলা কৃষি অফিসার জুবায়রা বেগম সাথী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বোরো আবাদে পানি সমস্যার বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। সেচের বিষয়টি বিএডিসি দেখে থাকে। সমস্যা সমাধানে একাধিকবার বিএডিসির প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। কিন্তু তারা এখনও আমাদের কোনও সমাধান দিতে পারেননি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ বিএডিসির সহকারী প্রকৌশলী জুলি আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার বৃষ্টি না হওয়ায় পানির স্তর নেমে গিয়ে গভীর নলকূপে পানি আসছে না। শেষ মুহূর্তে কৃষকরা সেচের সমস্যায় পড়েছেন। সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকরা আমাদের কাছে আসছেন। কৃষকদের অভিযোগ পেয়ে মাঠ সরেজমিন পরিদর্শন করেছি আমরা। সমস্যা সমাধানে গভীর নলকূপগুলো পুনঃখনন করতে হবে। তবে এই মুহূর্তে এটি সম্ভব না বিধায় নদী কিংবা খাল থেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে বরাদ্দ পেলে আগামী বোরো মৌসুমের আগেই গভীর নলকূপ পুনঃখননের মাধ্যমে পানি সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে।’