বাংলাদেশের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর মাছের পেটে মিলেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। একইসঙ্গে দুই নদীর পানি, পলি এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি দেখা গেছে। বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটানের বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রথমবারের মতো তিন দেশের যৌথ গবেষণায় দুটি নদীর পানি, পলি এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার হিসাব করা হলো।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটানের বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে যৌথভাবে এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ফর গ্লোবাল চেঞ্জ রিসার্চ-এর অর্থায়নে গবেষণাটি চালানো হয়।
গবেষকরা বলছেন, প্লাস্টিক দূষণের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। পাঁচ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট প্লাস্টিকের কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। পানি ও পলির সঙ্গে মিলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা মিশছে বঙ্গোপসাগরে। গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে, বিপুল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক পলিতে জমে যাচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষেত্রে রেয়নই সবচেয়ে বড় উপাদান আর রঙের মধ্যে নীলই প্রধান। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে পাঁচ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এগুলো নদী ও সমুদ্রে পড়ে যে দূষণ সৃষ্টি করছে, তা বৈশ্বিকভাবে উদ্বেগজনক। পদ্মা-মেঘনার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মাছের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে।
গবেষণা দলের প্রধান ড. হারুনুর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অংশে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর প্রতি বর্গ কিলোমিটার পানিতে ২৫ লাখের অধিক ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নদীত তলদেশের প্রতি কেজি পলিতে ৪৫০ পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। এসব নদ-নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে সংগৃহীত মাছের পেটেও বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি দেখা গেছে গবেষণায়।’
কীভাবে হলো গবেষণা
গবেষণা প্রকল্পের ফল থেকে জানা যায়, প্লাস্টিক দূষণের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। এখানে প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং ইরাবতী নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। বিগত দুই বছর ধরে এ গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে ভুটানের তিনটি পাহাড়ি নদী (হারাছু, মানস ও তোরসা) যেগুলো ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে; ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রের পাঁচটি মোহনা (টুটিং, দিব্রুগড়, তেজপুর, গোয়াহাটি ও ধুবরি) এবং বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পাঁচটি মোহনা (কুড়িগ্রাম, সুন্দরগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ ও হুমুরিয়া) থেকে গবেষণা প্রকল্পের নমুনা (পানি, নদীর তলদেশের পলি ও মাছ) সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে বায়ুতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরীক্ষা করা হয়।
ড. হারুনুর রশীদ বলেন, ‘গবেষণায় দেখা যায়, ভুটানের নদীগুলোর পানি ও পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ খুবই কম। কিন্তু উজানে ভারত ও ভাটির বাংলাদেশের অংশে ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনা নদীর পানি, পলি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য, কোনও কোনও ক্ষেত্রে উদ্বেগজনকহারে বেশি।’
মাইক্রোপ্লাস্টিক কীভাবে যাচ্ছে মানুষের শরীরে, গেলে যেসব সমস্যা হয়
ড. হারুনুর রশীদ বলেন, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত নদীর মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরে যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। রান্নার পরও এটি থেকে যাচ্ছে এবং খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পেটে যাচ্ছে। যা মানুষের অন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি, হরমোনের ক্রিয়াকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এমনকি আমাদের অন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ব্যাহত করে দিতে পারে। এ ছাড়া পেটে ফোলা ভাব, অস্বস্তি ও হজমের সমস্যার পাশাপাশি ক্লান্তিসহ নানা শারীরিক জটিলতা হয়ে থাকে। বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির কারণে কাশি ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার পাশাপাশি শরীরের হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমও ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে ওজন কমে যাওয়া, স্মৃতি বিভ্রাটসহ হাতের কাঁপুনিও হতে পারে।’
ন্যানো প্লাস্টিকেরও দেখা মিলেছে
এ ছাড়া গবেষণায় কয়েকটি নদ-নদীতে ন্যানো প্লাস্টিকের দেখা মিলেছে বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক হারুনুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘মাছের মাধ্যমে এই ন্যানো প্লাস্টিক মানুষের কোষে প্রবেশ করতে সক্ষম। এর ফলে মানুষের যকৃৎ ও কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কাজের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিট-২-এর প্রধান অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাছ খাওয়ার মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করলে মানুষ প্রজনন ক্ষমতা হারানো থেকে শুরু করে ফুসফুস ক্যানসার, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। এ থেকে বাঁচার উপায় প্লাস্টিক ব্যবহারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্লাস্টিক দূষণ রোধে কোম্পানিগুলোর প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। রিসাইক্লিং করে ধ্বংস করতে হবে।’
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, প্রতি বছর ১২ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বিভিন্ন সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। এ ছাড়া ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের তথ্য অনুসারে, প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতিবছর ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে রক্ষা পেতে কিছু পরামর্শ
মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে রক্ষা পেতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন কাজাখস্তানের নাজারবায়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোপ্লাস্টিক গবেষক ডানা ঝাক্সিলিকোভা। তিনি জানান, মাইক্রোপ্লাস্টিক সর্বত্র রয়েছে। এরই মধ্যে মানুষের প্রায় সব অঙ্গেই মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। প্লাস্টিকের পানির বোতল বা কাগজের মতো যে কাপ আমরা ব্যবহার করি, সেখানেও প্লাস্টিক কণা আছে। সমস্যা সমাধানে কাচ বা ধাতুর তৈরি পানির বোতল ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া প্লাস্টিকের পাত্রের মাধ্যমে মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম না করার পাশাপাশি প্লাস্টিকের পাত্র, টি-ব্যাগ, কাগজের কাপ ও প্লেট এড়িয়ে চলতে হবে।