বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনিসুর রহমানকে নেত্রকোনায় গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। বুধবার (০৮ জানুয়ারি) বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে কেন্দুয়া উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের কাউরাট দাখিল মাদ্রাসা মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শেষে সাইডুলী নদীর তীর সংলগ্ন কাউরাট গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশে তাকে শায়িত করা হয়।
জানাজায় ইমামতি করেন আনিসুর রহমানের ভাতিজি জামাই মাওলানা শফিকুল ইসলাম। এতে তার ছোট ভাই ভাষাবিদ আমিনুর রহমান, চাচাতো ভাই মোজাম্মেল হক মন্টু, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সারোয়ার জাহান কাউসার, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাজহারুল ইসলামসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
গত রবিবার দুপুরে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে আনিসুর রহমানের মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুকালে তিন মেয়েসহ অনেক স্বজন রেখে গেছেন। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় আনিসুর রহমানের মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। এরপর সেগুনবাগিচা জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা হয়।
আনিসুর রহমানের চাচাতো ভাই মোজাম্মেল হক মন্টু বলেন, ‘তিনি খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করেছেন। ক্ষমতা ও অর্থের লোভ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ব্যক্তিগত জীবনে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের থেকে একটু আলাদা। কোনও একসময় অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে আন্তজার্তিক পর্যায়ে উন্নীত হলেও সহজ-সরল আড়ম্বরহীন ব্যবহার ও চালচলনে কোনও পরিবর্তন কেউ দেখেননি। তিনি ছোটবেলা থেকেই ভোলা মানুষ ছিলেন। মানবিক ছিলেন। মানুষের অর্থনীতির মুক্তির লক্ষ্যে দেশের এক প্রাপ্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটেছেন।’
অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি চিন্তাশীল এই অর্থনীতিবিদের অবদান আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।’
আনিসুর রহমানের জন্ম ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়ায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণাপত্র তৈরিতে সহায়তা করেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকও ছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন আনিসুর রহমান।
তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘পথে যা পেয়েছি’তে লেখা হয়েছে, ১৯৭৭ সালে আনিসুর রহমান জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আমন্ত্রণে ওই সংস্থায় যোগ দেন। সেখানে তিনি গ্রামীণ উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণের ওপর একটি বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেই কর্মসূচি তিনি পরিচালনা করেন। ১৯৯১ সালে অধ্যাপক আনিসুর রহমান দেশে ফিরে আসেন। অংশীদারি গবেষণা এবং আত্মনির্ভর অংশীদারি উন্নয়নের দর্শন ও পদ্ধতিগত প্রশ্নে তার অবদান বিশ্বস্বীকৃত এবং বিভিন্ন দেশে এই কাজে তার চিন্তা ও রচনাবলি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সমাজ ও উন্নয়ন-দর্শন ছাড়া অধ্যাপক আনিসুর রহমান রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী এবং গবেষক হিসেবে সুবিদিত।
অধ্যাপক আনিসুর রহমানের অন্য বইগুলোর মধ্যে আছে উন্নয়ন জিজ্ঞাসা, যে আগুন জ্বলেছিল: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, মাই স্টোরি অব ১৯৭১, অপহৃত বাংলাদেশ ইত্যাদি।