ময়মনসিংহে বন্যা

‘বউ-পোলাপাইনরে স্কুলঘরে রাইখা আইছি, গরু-বাছুর নিয়া কই যামু’

‘বাড়িঘরে পানি উইঠা গেছে, বউ পোলাপানরে কোনোমতো স্কুলঘরে রাইখা আইছি। গোয়ালঘরের গরু-বাছুর কই নিয়া যামু? এগুলারে আর বাইর করতে পারি নাই। তিন দিন ধইরা পানির মধ্যেই দাঁড়াইয়া আছে। খাবারও খাওয়াইতে পারতাছি না। জানি না বানের পানিতে গরু-বাছুর বাঁচাতে পারমু কিনা।’ এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া গ্রামের কৃষক কলিমুদ্দিন (৫৫)।

শুক্রবার (৪ অক্টোবর) দুপুরের পরেই ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কলিমুদ্দিনের বাড়িঘরে পানি উঠে যায়। দ্রুতই বন্যার পানি বাড়িঘরে উঠে যাওয়ায় স্ত্রী ঝরনা বেগম এবং পাঁচ সন্তানকে নিয়ে কোনোমতো কাপড়চোপড়সহ কিছু মালামাল নিয়ে দক্ষিণ মাইজপাড়া স্কুলঘরে আশ্রয় নেন তিনি। পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে গোয়ালঘরে থাকা আটটি গরু-বাছুর আর বের করতে পারেননি। শুক্রবার থেকেই পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে গবাদিপশুগুলো। গরু-বাছুর গোয়ালঘরে থাকায় কৃষক কলিমুদ্দিন বাড়ি ছেড়ে স্কুলঘরে যেতে পারেননি।

তিনি বলেন, ‘জমিতে চাষাবাদের পাশাপাশি গরু লালনপালন করে বউ বাচ্চাদের নিয়ে দিন যাপন করে আসছি। আটটার মধ্যে চারটা গরু দুধ দেয়। আর দুধ বিক্রি করেই সংসারের খরচ চলে। বন্যায় আমন ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এবার বন্যার পানির মধ্যে গরুগুলো বাঁচাতে পারমু কিনা, এই নিয়ে চিন্তায় ঘুম আসছে না।’

শুধু দক্ষিণ মাইজপাড়া গ্রামের কৃষক কলিমুদ্দিন না, ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার হাজার হাজার কৃষক হঠাৎ বন্যার কবলে পড়ে বিপাকে পড়েছেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে আমন ধানের ফসলি জমি ও মাছের খামার।

ধোবাউড়া সদর ইউনিয়নের কৃষক আবুল হাশেম জানান, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৪০টির ওপরে গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রত্যেকের বাড়িঘরে পানি উঠেছে। আমন ধান, মাছের খামার, রাস্তাঘাট সব তলিয়ে গেছে। দুর্গত মানুষজন নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু জায়গা, স্কুলসহ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। অনেকের রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে গেছে। বিশুদ্ধ পানিসহ শুকনো খাবারের সংকটে পড়েছেন তারা।

ধোবাউড়ার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির জানান, ধোবাউড়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ হঠাৎ বন্যায় ভীষণ বিপদে পড়েছেন। এসব মানুষের বন্যার কোনও প্রস্তুতি ছিল না। ভারী বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হঠাৎই এমন বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। বন্যাপরবর্তী সময়ে এসব কৃষকরা বাড়িঘর ঠিকঠাক করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করতে বেশ কষ্টের মধ্যে পড়বে। তাই ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করে সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত শারমিন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ধোবাউড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যার পানি কমে আসলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে। তবে বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে সবাইকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) রাত থেকেই ভারী বর্ষণের পাশাপাশি ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে শুক্রবার দুপুরের মধ্যে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এবং ধোবাউড়া উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়। এরপরে বন্যার পানি বেড়ে গিয়ে দুই উপজেলার প্রায় ৮০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। বন্যার পানিতে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।