খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) আবাসিক হল রবিবার (১৩ এপ্রিল) রাত ৮টার মধ্যে খুলে দেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আজ বিকাল ৫টার দিকে কুয়েটের প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রশাসনের কাছে আবেদনের কপি তুলে দেন শতাধিক শিক্ষার্থী। আবেদনপত্র গ্রহণ করেন ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) অনুষদের ডিন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
তবে সিন্ডিকেটের সভা ছাড়া হল খোলা ও একাডেমিক কার্যক্রম শুরু সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সন্ধ্যার পর থেকে ক্যাম্পাসের দুটি গেটে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, রাত ৮টার মধ্যে হল খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আবেদন দেওয়া হয়েছে। এ সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান করবেন। তাদের দাবি না মানা হলে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার কথা জানান তারা। আবেদন জমা দেওয়ার শেষে শিক্ষার্থীরা, ‘মানি না মানবো না, হল ভ্যাকান্ট মানবো না’; ‘আমার হল আমার হল, খুলতে হবে খুলতে হবে’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
এর আগে বিকাল সোয়া ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। কুয়েটের প্রধান ফটকের বাইরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষক কথা বলতে যান। এ সময় শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান এবং ক্যাম্পাসের ভেতরে না ঢুকতে অনুরোধ করেন। বেলা ২টার দিক থেকে শিক্ষার্থীরা দু-একজন করে কখনও আবার ছোট ছোট দলে কুয়েট প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হতে থাকেন। নতুন করে কোনও শিক্ষার্থী এলে আগে থেকে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীরা তাদের হাততালি দিয়ে স্বাগত জানান।
এরপর আইডি কার্ড দেখিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করেন তারা। ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ পর বিভিন্ন হলের প্রভোস্ট, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের দফতরের কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। শিক্ষকদের মধ্যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন রোকেয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আশরাফুল আলম, কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. ফারুক হোসেন, ইইই অনুষদের ডিন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ছাত্রকল্যাণবিষয়ক দফতরের সহকারী পরিচালক সহকারী অধ্যাপক রাজন রাহা, অমর একুশে হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আবু ইউসুফ, ড. এম এ রশীদ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আওলাদ হোসেন।
বিকাল পৌনে ৪টার দিকে শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষার্থীদের কাছে আসেন। এ সময় শিক্ষকরা বলেন, হল বন্ধ করা হয়েছে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে। তাই হল সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত ছাড়া খোলা সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তারা। এ সময় শিক্ষকদের একজন বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজ জমা হবে। তোমরা দেখো সেখানে কেউ শাস্তি পায় কি না বা বিচার হয় কি না। তোমরা আমাদের এটা বলতে পারো, স্যার আপনারা আজ হল খুলতে পারছেন না, কিন্তু আগামী সাত দিন বা ১০ দিনের মধ্যে হল খুলে একাডেমিক কার্যক্রম চালু করেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এসে যদি বলো যে আজ হল খুলতে হবে, বিশ্বাস করো সেটার এখতিয়ার সিন্ডিকেট ছাড়া আমাদের নেই।’
তখন শিক্ষার্থীরা বলতে থাকেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে খুব স্বল্প সময়ে যদি সিন্ডিকেট হল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারে তবে এখন হবে না কেন। এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যারেরা আমাদের জন্য কাজ করছেন বলছেন। স্যারেরা নিশ্চয় আমাদের দাবি রাখবেন। আমরা এখানেই বসে থাকবো।’
শিক্ষকরা জানান, ছাত্রকল্যাণ দফতর থেকে এবং রেজিস্ট্রারের দফতর থেকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেটার পরও এ অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শিক্ষকরা। জবাবে শিক্ষার্থীরা বলেন, ৫ আগস্টের আগেও শেখ হাসিনাও বাসা থেকে বের না হতে বলেছিলেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের আলোচনা থমকে যায়।
পরে শিক্ষার্থীরা প্রেস ব্রিফিংয়ে এসে বলেন, হল ও একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমাদের লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী হলে থেকে বাইরে টিউশনি করেন। তারা টিউশনি করতে পারছেন না। এ নিয়ে অনেকে কষ্টে আছেন। আজ রাত ৮টার মধ্যে হল খুলে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করেছি আমরা। কর্তৃপক্ষ যদি দাবি পূরণ না করে তাহলে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করবো।
কুয়েটের সিন্ডিকেট সদস্য ও ইইই অনুষদের ডিন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা হল খুলে দেওয়ার জন্য লিখিত একটি আবেদন জানিয়েছেন। বিষয়টি শিক্ষক প্রতিনিধিরা উপাচার্যকে জানিয়েছেন। তবে সিন্ডিকেটের সভা ছাড়া হল খোলা ও একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ৯৯তম (জরুরি) সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষা কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সব আবাসিক হল খালি করে সিলগালা করা হয়েছে। হলে উঠা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে কুয়েট ক্যাম্পাসে উত্তেজনা তৈরি হয়। শিক্ষার্থীরা বন্ধ থাকা ক্যাম্পাসে আজ সবাই একসঙ্গে হলে ওঠার ঘোষণা দেওয়ায় এ উত্তেজনা তৈরি হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে বন্ধ ক্যাম্পাসে না ফেরে এ বিষয়ে তৎপরতা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একাধিক সভা, প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে চিঠি, বিজ্ঞপ্তি জারি ও অভিভাবকদের মোবাইলে খুদে বার্তা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে না পাঠানোর অনুরোধ জানায়। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রবেশ ঠেকাতে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
উত্তেজনায় নতুন রসদ জুগিয়েছে একটি মামলা। কুয়েটের ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালতে মামলা করেছেন নগরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার মো. হোচেন আলী নামের এক ব্যক্তি। আদালত বাদীর অভিযোগ আমলে নিয়ে খানজাহান আলী থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল শনিবার ওই মামলার বিষয়টি জানাজানি হয়। বাদী তার অভিযোগে উল্লেখ করেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তিনি কুয়েট রোড দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন। পকেট গেটের সামনে গেলে আসামিরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে রড ও লাঠি দিয়ে মারধর করেন এবং স্বর্ণের চেন ছিনিয়ে নেন।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে কমিটিও করা হয়েছে। ওই দিন রাতেই খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে প্রশাসন।