ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের ২ মাস পরও উপকূলে হাহাকার

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের দুই মাস পার হলেও খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলজুড়ে চলছে হাহাকার। কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপসহ খুলনা অঞ্চলের উপকূলজুড়ে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। চারদিক লবণ পানিতে সয়লাব হওয়ায় সুপেয় পানির জন্য বৃষ্টিই ভরসা। কিন্তু বর্ষা মৌসুমেও নেই প্রত্যাশিত বৃষ্টি। পানিবন্দি হওয়ার কারণে শিশুদের খেলার মতো জায়গাও নেই। নেই নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থাও। খোলা জায়গা ও নদীর তীরে মল ত্যাগের ফলে পরিবেশ আরও দূষিত হয়ে উঠছে। শিশু ও গর্ভবতী নারীরা পুষ্টি সংকটে ভুগতে শুরু করেছে।

স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, পুষ্টিকর খাদ্য সংকট আছে। কিন্তু তার প্রভাব এখনও দেখা যাচ্ছে না। রিমালের আঘাতের দুই মাসেও স্বাভাবিক হতে পারেনি খুলনার উপকূলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় চার লাখ মানুষ।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের তেলিখালী গ্রামের বাসিন্দা ফাতেমা বেগম বলেন, রিমালের আঘাতে বসত ঘর, গোয়াল ঘর ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গৃহপালিত পশু পাখিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৪টি হাঁস ও ৭টি মুরগি ছিল। যার সহায়তায় বছরে ১০-১৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত আয় নিশ্চিত হতো। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চলতো। রিমালে আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এখন টানাপোড়েন চলছে। সরকারি বেসরকারি সহায়তা পেলেও ৩০ হাজার টাকা লোন করতে হয়েছে। এর কিস্তি পরিশোধে চাপ রয়েছে। লোনায় সয়লাব সব, এখন দিনের আয় দিনে নিশ্চিত করতে কষ্ট করতে হচ্ছে। কিন্তু দিনের প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। লোনের কিস্তি পরিশোধ করাও কঠিন হচ্ছে। এসএসসিতে ভালো ফলাফল করার পরও মেয়েকে শহরের ভালো কলেজে ভর্তি করাতে পারিনি। অর্থাভাবে তাকে গ্রামের কলেজেই রাখতে হয়েছে।

তেলিখালির পিয়া বেগম জানান, স্বামীর আয়ের পাশাপাশি ২০টি হাঁস ও ১৫টি মুরগি পালনের মাধ্যমে বার্ষিক একটা বড় সাপোর্ট হতো। এখন রিমালের আঘাতে সব শেষ। ঋণ করে ঘর তুলে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও সংসার চালাতে পারছেন না। ২ ছেলে নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। হাঁস মুরগি দিয়ে পুষ্টি চাহিদা মেটাতো। এখন লবণের কারণে খাবারই পাওয়া যাচ্ছে না, পুষ্টি নিয়ে চিন্তা করাই কঠিন।

সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নাহিদ হাসান তেলিখালির ভাঙা বাঁধ দেখিয়ে বলে, এই বাঁধ ভেঙে এই এলাকা লবণ পানিতে তলিয়ে গেছে। এই জমিতে খেলতাম। কিন্তু এখন খেলার জায়গা নেই। খাবার পানিরও সংকট। লবণ পানিতে সমস্যা হয়। ফুলবাড়ি বাজার থেকে পানি কিনে আনতে হয়।

তেলিখালির নিবাসী সাইফুল বিশ্বাস জানান, তিন বিঘা জমিতে মাছ চাষ ও ফসল চাষাবাদ করে ভালোই কাটছিল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতেও নিজের ঘেরের মাছ, জমির সবজিতে কোনোভাবে দিন পার করছিলেন। কিন্তু প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল তার সব কিছু পাল্টে দিয়েছে। বাঁধ ভেঙে গোটা জমিতে এখন লবণের আগ্রাসন। তেলিখালীর এই বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ভেসে যায় ঘেরের মাছ, নষ্ট হয় ফসল ও সবজির ক্ষেত। রিং বাঁধ তৈরি করে নোনা পানি প্রবেশ বন্ধ করার চেষ্টা চললেও কৃষিপ্রধান এলাকার কৃষকরা সর্বস্বান্ত হন।

ক্ষতিগ্রস্ত তেলিখালীর মোস্তফা গাজী ও জাহানারা বেগম দম্পতি গত ১২ জুলাই নতুনভাবে ঘর তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। জাহানারা বেগম বলেন, এক ঝড়ে দেড় লাখ টাকা ঋণ করতে হল। সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছু টিন ও টাকা পেয়েছি। আগের ঘরটি ভালোই ছিল। ফসল-মাছ কিছুই নেই।

ফুলবাগী বাজার এলাকার আব্দুর রশিদ শেখ (৫২) বলেন, রিমালে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বাচ্চাদের একটু মাছ মুখে দেব তা-ও পারতেছি না। লবণের কারণে একটা সবজির চারাও হচ্ছে না।

গোপী পাগলা শ্মশানঘাট এলাকার সালমা বিশ্বাস ও ইউসুফ বিশ্বাস বলেন, দেলুটি ইউনিয়নজুড়ে খাবার পানির কষ্ট। বৃষ্টি হলে কয়দিন চলে। ঝড়ে সব কিছু শেষ করে দিয়েছে। আমাদের এখন না খেয়ে মরার অবস্থা।

বিগরদানা গ্রামের বাসিন্দা লাল মিয়া (৪৩) বলেন, দেলুটির সব বাড়ি ও ক্ষেতে শাক-সবজিসহ অন্য ফসল হতো। রিমালের তাণ্ডবে তেলিখালীসহ বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙেছে। নোনা পানি আর ঝড়ে সব কিছু নষ্ট হয়েছে। এই ক্ষতি থেকে বাঁচতে কষ্ট করতে হচ্ছে। শেষ রক্ষা হবে কি না জানি না। কারণ চেষ্টা করেও আগাতে পারছি না।

পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রামচন্দ্র টিকাদার বলেন, ঝড়ে আমার মাছের খামার, ফসল সব শেষ। আগামীতে পরিবার নিয়ে কেমনে বাঁচব জানি না। আগের মৌসুমে এখানে তরমুজ চাষে পাঁচ কোটি টাকা আয় হয়েছিল। এবার নোনা পানিতে জমি নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষের কষ্টের শেষ নেই। দুর্গম এলাকা, রাস্তাঘাটও ভালো না।

ক্লাইমেট জাস্টিস ফোরাম খুলনার সভাপতি ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ইউআরপি ডিসিপ্লিনের প্রধান ড. তুষার কান্তি রায় বলেন, যেকোনো দুর্যোগে ভুক্তভোগীরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি তাদের জীবন-জীবিকাকে পাল্টে দেয়। তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রথমে টেকসই অবকাঠামো প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠী। এসব ক্ষতি মোকাবিলায় বিদ্যমান রূপরেখা, নীতির বাস্তবায়ন করতে হবে।

উল্লেখ্য, গত ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে খুলনার ৬৮টি ইউনিয়ন, দুটি পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ড কমবেশি ক্ষতির শিকার হয়। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ৭৬ হাজার ৯০৪টি। ৫৫টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙেছে ও উপচে পানি ঢুকেছে। ১২ হাজার ৭১৫.৫ হেক্টর জমির ফসল, পাঁচ হাজার ৫৭৫টি মাছের ও চিংড়ি ঘের, তিন হাজার ৩০০ পুকুর ভেসে গেছে। আর দুর্গত মানুষের সংখ্যা চার লাখ ৫২ হাজার ২০০ জন।