এক ঝুট ব্যবসায়ীর কাছে গাজীপুরের শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জয়নাল আবেদীন মণ্ডলের ঘুষ চাওয়ার কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছে। গতকাল রবিবার রাত থেকে কথোপকথনের অডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়ে। অডিওটি প্রায় তিন মাস আগের। তখন মাসে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছেন ওসি, না পেয়ে ওই ব্যবসায়ীকে জেলে পাঠান। এক মাস জেল খেটে জামিনে মুক্ত হন ব্যবসায়ী।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর নাম সেলিম সিকদার। তিনি শ্রীপুরের গাজীপুর ইউনিয়নের নগরহাওলা গ্রামের জালাল উদ্দিনের ছেলে। ফাঁস হওয়া অডিওর কথোপকথন ওসির সঙ্গে তারই বলে বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন সেলিম। অডিও ফাঁস হওয়ার পর থেকে ওসি তাকে হুমকি দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন।
অডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার (২১ এপ্রিল) সকালে ঝুট ব্যবসায়ী সেলিম সিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অন্তত তিন মাস আগে শ্রীপুর থানার ওসি জয়নাল আবেদীন আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ চাওয়ার ওই কথোপকথনের অডিও রেকর্ড করেছিলাম। এর মধ্যে আমার মোবাইলটি হারিয়ে যায়। পরে সেটি উদ্ধার করেছি। কিন্তু সেই অডিও কীভাবে ফাঁস হলো, তা আমার জানা নেই। এটি ফাঁস হওয়ার পর থেকে অব্যাহতভাবে আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছেন ওসি। এ নিয়ে আতঙ্কে আছি। এরই মধ্যে ওসি একটি কাগজে একটা লেখা লিখে আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। ওসি বলেছেন, ফেসবুক লাইভে এসে যেন বলি অডিও রেকর্ডটি ভুয়া। তাহলে আমার কোনও সমস্যা হবে না। না হয় সমস্যা হবে।’
ফাঁস হওয়া ৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের অডিও কথোপকথনে মোবাইলের অপর প্রান্তে ওসিকে বলতে শোনা যায়, তিনি স্থানীয় একজনের মধ্যস্থতায় সেলিম সিকদারকে কারখানা থেকে ঝুট বের করতে সহযোগিতা করছেন। স্থানীয় ওই ব্যক্তিকে এক লাখ ৩০ হাজার টাক দিলে বিনা বাধায় ঝুট বের করে নিয়ে যেতে পারবেন বলে ওসি সেলিম সিকদারকে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। অডিওর একপর্যায়ে ওসিকে বলতে শোনা যায়, ‘তোর নানা আমাকে দেখে না কেন? আমি এতো কিছু করতেছি, চাপ নিতেছি। তোর নানাকে বলে আমাকে লাখ পাঁচেক টাকা দিস।’ অডিওর অন্য অংশে সেলিম সিকদারের কাছে ওসিকে ফুলহাতা গেঞ্জিও চেয়েছেন।
এ ব্যাপারে সেলিম সিকদার বলেন, ‘নগরহাওলা গ্রামে রিদিশা গ্রুপের ফর্মুলা ওয়ান কারখানার জন্য ১০-১২ বছর আগে জমি কিনে দেওয়াসহ কারখানা স্থাপনে সহযোগিতা করেন আমার নানা। এ সুবাদে কারখানা স্থাপনের পর থেকে আমি আর নানা ঝুট ব্যবসা করে আসছি। কোনও রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে ব্যবসা করিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও আমাদের ব্যবসায় বাধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কারখানার মালিক বলেছেন, যেহেতু আমার নানা কারখানার জমি কিনে দিয়েছেন, এই সূত্রে আমাদের ব্যবসা করতে দিয়েছেন। এরপর আর কখনও কোনও সমস্যা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু ৫ আগস্টের পর ওসি জয়নাল আবেদীন এই থানায় আসার পর এক উপপরিদর্শকের (এসআই) কাছ থেকে আমার মোবাইল নম্বর নিয়ে কল দিয়ে থানায় যেতে বলেন। থানায় যাওয়ার পর ওসি বলেন, যদি ব্যবসা করতে চাও তাহলে মাসে দুই লাখ টাকা দিতে হবে। না হয় ব্যবসা করতে পারবে না। ভয়ে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। তখন ওসিকে বললাম স্যার ব্যবসাই হয় দুই-তিন লাখ। কীভাবে মাসে দুই লাখ টাকা দেবো? পরে এক লাখ টাকা মাসে ওসিকে দেওয়ার চুক্তি হলো। পরের মাসে এক লাখ দিয়েছিলাম। এর পরের মাসে নিয়েছেন দুই লাখ। এরপর প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই লাখ করে নিয়েছেন। গত জানুয়ারি মাসে ফোন দিয়ে মাসে পাঁচ লাখ টাকা চান ওসি। তাকে বললাম, ব্যবসা ওরকম নেই। যে দুই লাখ করে চেয়েছেন, তা দেবো। পাঁচ লাখ দিতে পারবো না। এ নিয়ে ওসি ক্ষুব্ধ হন। তখন স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার মাধ্যমে থানায় ডেকে নিয়ে আমাকে আটক করা হয়। সেইসঙ্গে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি। ১০ লাখ টাকা দিতে হবে, না হয় ১০টা হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে চালান দেওয়ার কথা বলেন। কোনও উপায় না পেয়ে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানোর শর্তে নিজের গরু বিক্রি করে আড়াই লাখ টাকা দিই। ওসি বলেন, ৫৪ ধারায় চালান দেবেন। কিন্তু টাকা হাতে পাওয়ার পর ওসি থানায় সেদিন আসেননি। উল্টো গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় একটি হত্যা মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এক মাস কারাগারে থাকার পর রোজা শুরুর ছয় দিন আগে জামিনে বের হই।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি জয়নাল আবেদীন মণ্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অডিওটি আমি শুনেছি, এটা আমার কণ্ঠ নয়। আমার কথা এডিট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে একটি চক্র।’
এ ব্যাপারে জানতে গাজীপুরের পুলিশ সুপার চৌধুরী মো. যাবের সাদেকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি।